বিংশ শতাব্দীর নারী বিজ্ঞানীদের মধ্যে মেরি কুরির পরই উচ্চারিত হয় লিসে মাইটনারের নাম। তিনি ১৯৩৮ সালে প্রথম নিউক্লিয়ার ফিশন (একটি বড় পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে ভেঙ্গে ছোট ছোট দুই বা ততধিক নিউক্লিয়াস তৈরি করা হয়) বিক্রিয়া আবিষ্কার করেন। দেখিয়ে দেন, নিউক্লিয়ার বিভাজনই পারমাণবিক শক্তির উৎস। লিসে মাইটনার ১৮৭৮ সালের ৭ নভেম্বর অস্ট্রিয়ার একটি বনেদি ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে লিসে মাইটনারের শিক্ষক বোল্ট্জম্যান (বিখ্যাত পদার্থবিদ Ludwig Boltzman) আত্মহত্যা করলে মাইটনারের মানসিক অবস্থা ভীষণ ভেঙ্গে পড়ে। তিনি অস্ট্রিয়া ছেড়ে চলে যান জার্মানের বার্লিনে। বার্লিনেই মূলত পদার্থবিদ্যার উপর তার বিশেষ গবেষণা শুরু হয় এবং এখানেই তার সাথে দেখা মেলে আর এক বিখ্যাত পদার্থবিদ অটো হানের (বিখ্যাত জার্মান ভৌত রসায়নবিদ, জন্ম ১৮৭৯ সালে)। পরবর্তীতে তারা দুজন একই সাথে “এমিল ফিশার রাসায়নিক ইনস্টিটিউট” নামক একটি প্রতিষ্ঠানে প্রায় ত্রিশ বছর কাজ করেন। এই ত্রিশ বছরই ছিল মাইটনারের পুরো গবেষণা জীবনের সেরা মাইলফলক। মাইলফলক বললাম এ কারণে যে, এখানে গবেষণা করতে করতে অটো হান এবং মাইটনার যৌথভাবে উপহার দেন বিজ্ঞান জগতের বড় দুটি আবিষ্কার। ১৯০৮ সালে তারা ‘অ্যাকটিনিয়াম’ নামক একটি তেজষ্ক্রিয় মৌলের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করেন এবং ১৯১৮ সালে আবিষ্কার করেন দ্বিতীয় মৌল, যার নাম ‘প্রোট্যাক্টিনিয়াম’।
পূর্বেই বলেছি, লিসে ইহুদি ছিলেন। পরবর্তীকালে এই ইহুদি হওয়ার জন্যই তিনি বাধ্য হয়েছিলেন হিটলারের একনায়কতন্ত্রে জর্জরিত জার্মানি ছেড়ে পালাতে। পদার্থবিদ্যা নিয়ে তাঁর পড়াশুনা শুরু হয় ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে, এবং পরবর্তীকালে (১৯০৫) পদার্থবিদ্যায় ডক্টরেট উপাধিও লাভ করেন ওই একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তিনি ছিলেন ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট অর্জন করা দ্বিতীয় মহিলা বিজ্ঞানী।

এরপর লিসে সিদ্ধান্ত নিলেন বার্লিন যাওয়ার, স্বয়ং ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের কাছ থেকে সম্মতি পেয়েছিলেন ক্লাসঘরে বসে তাঁর (প্ল্যাঙ্কের) বক্তৃতা শোনার। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে এ এক অভাবনীয় ঘটনা। কারণ তার আগে পর্যন্ত সমস্ত মহিলার আবেদনপত্র খারিজ করে দিয়েছিলেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। বার্লিনে লিসে অটো হানের সাথে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীকালে এই অটো হান-ই হয়ে ওঠেন তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু। একদিকে লিসা গবেষণা করতেন তেজস্ক্রিয় পদার্থের পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে আর অন্যদিকে সেই সব পদার্থের রাসায়নিক ধর্ম নিয়ে মেতে থাকতেন অটো হান।
তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে অটো এবং লিসা একজোট হয়ে কাজ করেছিলেন। দু’জনের মধ্যে তৈরি হয়েছিল এক প্রগাঢ় বন্ধুত্বের সম্পর্ক। কিন্তু দু’জনের চরিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। লিসা অতিমাত্রায় লাজুক আর অটো ছিলেন অতি সপ্রতিভ। তাঁরা একসাথে কাজ করেছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁদের দুজনের জন্য পরিস্থিতিটা মোটেও এক ছিল না। সে এক প্রকট লিঙ্গ বৈষম্যের সময়। গোড়ার কয়েকটা বছর লিসা তো তাঁর পারিশ্রমিকই পেতেন না, পরে যাও বা পেতেন তা ছিল অটো হানের পারিশ্রমিকের তুলনায় নিতান্তই সামান্য। তবে তাঁদের যৌথ প্রয়াস বিজ্ঞানের জগতে এনে দেয় দারুণ কিছু ফলাফল, যেমন– ১৯১৮-এ প্রোট্যাক্টিনিয়াম নামে নতুন মৌলের আবিষ্কার। তবে লিসার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান হলো ১৯৩৮ সালে নিউক্লিয়ার ফিশন-এর আবিষ্কার।
“লিসে হলেন আমাদের জার্মানীর মেরি ক্যরি।”
–অ্যালবার্ট আইনস্টাইন
১৯৩৩ সাল নাগাদ বার্লিনে বসবাসকালে ইহুদি জন্মপরিচয়ের কারণে লিসেকে বহু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তখন তিনি ছিলেন বার্লিনের কায়সার উইলহেম ইনস্টিটিউট ফর কেমিস্ট্রির পরিচালিকা এবং একই সাথে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের পূর্ণ দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন অধ্যাপিকা । সেই বছরেই, শিক্ষাজগতের সাথে জড়িত সমস্ত ইহুদিদের আইন মোতাবেক বাধ্য করা হয়েছিল তাদের পদ ছেড়ে দিতে।
বিজ্ঞানকে পর পর এতগুলো অমূল্য সম্পদ উপহার দেয়া এ বিজ্ঞানী চিরকালই শুধু অবহেলা পেয়েছেন। একদিকে ইহুদি হবার কারণে নানা ধরনের নির্যাতন, অন্যদিকে নারী হবার কারণে নানা ধরনের লাঞ্চনা, বঞ্চনা। বিজ্ঞান বিশ্বকে লিসে মাইটনার যা দিয়েছেন তা কখনো অস্বীকার করার নয়। অথচ এরকম মূল্যবান আবিষ্কারের পরও নোবেল কমিটি তাকে না দিয়ে শুধুমাত্র অটো হানকে নোবেল দিল। অবশ্য হান এবং লিসে দুইজনকে যৌথভাবে নোবেল দেবার ব্যাপারে সমর্থন জানিয়েছিলেন প্ল্যাঙ্কসহ বড় বড় বিজ্ঞানীরা। কিন্তু ওই যে সাম্প্রদায়িক প্রভাব! সেটা থেকে নোবেল কমিটিও মুক্ত নয়। নোবেল পুরষ্কারের ইতিহাসে এই বড় ভুলকে চিহ্নিত করা হয় “নোবেল মিসটেক” হিসেবে। নারী না হয়ে জন্মগ্রহণ করলে হয়তো অটো হানের পরিবর্তে নোবেলটা তাকেই আগে দেয়া হতো।
নোবেল না পেলেও মাইটনার পেয়েছেন আন্তর্জাতিক মানের অসংখ্য পুরষ্কার। ১৯৯৭ সালে সালে তাকে সম্মান জানিয়ে তার নামানুসারে পর্যায় সারণির মৌল ১০৯-এর নাম দেওয়া হয় মাইটনারিয়াম (Mt)। ম্যানহাটন প্রকল্পের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেবার পর মানবতাবাদী এই বিজ্ঞানী বেশ কিছু বছর যুদ্ধ এবং যুদ্ধের ভয়াবহতার বিপক্ষে এবং বিজ্ঞানের পক্ষে প্রচার করে কাটিয়েছেন তার দিন। অবশেষে অবসর নেবার কিছুদিন পর ১৯৬৮ সালে কেমব্রিজে অনন্তকালের পথে পাড়ি জমান অবহেলিত এই মহীয়সী নারী বিজ্ঞানী। আজও হৃদয়ে দাগ কাটে তার সমাধিপ্রস্তরে খোদাই করা তার ভাগ্নের সেই কথাটি,
“লিসা মাইটনার: এক পদার্থবিজ্ঞানী যিনি কখনো তাঁর মনুষ্যত্বকে হারাননি।”
“নিঃস্বার্থভাবে মানুষকে সত্য ও নিরপেক্ষতার কাছে পৌঁছে দেয় বিজ্ঞান; বিস্ময়ের সাথে শেখায় বাস্তবকে গ্রহণ করতে, স্বীকৃতি দিতে। একইসাথে, একজন প্রকৃত বিজ্ঞানীর মনে তার চারপাশের জগতের স্বাভাবিক গঠন এনে দিতে পারে এক গভীর সম্ভ্রম আর আনন্দের ছোঁয়া।”
–লিসা মাইটনার
সূত্র:
- উইকিপিডিয়া
- লিসে মাইটনার, অবহেলিত অথচ মহীয়সী এক বিজ্ঞানী | বিজ্ঞান যাত্রা | বিপ্লব হোসাইন
- বিজ্ঞান