সালের হিসেবে তখন ১৮৬৭। ভারতীয় উপমহাদেশে বিজ্ঞান তখনও বেশ অনগ্রসর। গবেষকও তেমন বিশেষ নেই বললেই চলে। অথচ সারা বিশ্বে তখন পরীক্ষানির্ভর আধুনিক বিজ্ঞান অনেক এগিয়ে। আর উন্নত বিশ্বে গবেষণার জন্য, বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানীদের জন্য তো রয়েছে অনেক বড় বড় নামকরা খ্যাত-বিখ্যাত অসংখ্য সংগঠন, গবেষণাগার। বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানীদের কোনো খ্যাত-অখ্যাত প্রতিষ্ঠানই নেই কেবলমাত্র ভারতীয় উপমহাদেশে। নেই কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান, নেই বিজ্ঞান শিক্ষার তেমন ভালো কোনো ব্যবস্থা। আর এই যে নেই এর অভাব তা বোধ করি সব থেকে বেশিই অনুভব করেছিলেন একজন বাঙালি চিকিৎসাবিদ। মহেন্দ্রলাল সরকার নাম তার। শুধু যে অভাব বোধ করেছেন এমনটাও নয়, তার সাথে বিজ্ঞানীদের জন্য গবেষণারের কোনো রকম একটি ব্যবস্থা, একটি বিজ্ঞান সংগঠন; একটি দেশের, সমাজের বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানীদের জন্য যে কতটা বেশি প্রয়োজনীয় তা আর একটু বেশিই অনুভব করতে পেরেছিলেন। আর এই প্রয়োজনের তাগিদেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এমন একটি বিজ্ঞান সংগঠন প্রতিষ্ঠার জন্য। উদ্দ্যেশ্য একটাই এই সংগঠনের মাধ্যমে একদল ভারতীয় বিজ্ঞানীর সৃষ্টি হবে। তৈরি হবে বড় বড় সব নামকরা গবেষক। এখানে তারা নানান প্রকার গবেষণা করবেন, আবিস্কার করবেন। সকল প্রকার কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে বিজ্ঞানের মাধ্যমে লড়াই করবেন। উন্নত, আধুনিক এবং বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ উপহার দেবেন পুরো মানবজাতিকে। আর সেই স্বপ্ন নিয়ে ছুটতে থাকলেন দুর্নিবার।
ভারতীয়দের অর্থায়ন, নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত এবং গবেষণাসহ একটি স্বায়ত্তশাসিত সমিতি প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করলেন সাদা চামড়াওয়ালা ব্রিটিশ শাষকদের কাছে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার সম্পূর্ণ নীরব ভূমিকা পালন করে গেলেন। তারা এদেশে এসেছেন শাসন আর শোষন করতে। তারা তাই করবেন। এদেশের বিজ্ঞান এগুলো কি পড়ে থাকল তাতে তাদের কি ই বা আসে যায়। পরবর্তীতে মহেন্দ্রলাল সরকার সরকারের মুখ আর না চেয়ে দেশীয় শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানে আগ্রহীদের সহায়তা নিয়ে নিজেই প্রতিষ্ঠা করলেন ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কালটিভেশন অব সায়েন্স‘। প্রতিষ্ঠাকালীন দপ্তর করা হয় কলকাতার ২১০ বৌ বাজার স্ট্রিটে। তার প্রতিষ্ঠিত এই ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কাল্টিভেশন অব সায়েন্স ই হলো ভারতীয় উপমহাদেশে বিজ্ঞানীদের জন্য প্রথম বিজ্ঞান সমিতি। যার কৃতিত্ত্বস্বরুপ মহেন্দ্রলাল সরকার উপমহাদেশে বিজ্ঞানের জনক বলে খ্যাত হয়েছেন। মহেন্দ্রলাল সরকার এবং তার ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কাল্টিভেশন অব সায়েন্স সম্পর্কে আর এক মহারথী বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র রায় তার আত্মচরিত প্রবন্ধে বলেছিলেন,
“এদেশের কলেজ সমাহে রসায়ন শাস্ত্রের আদর তখনও হয় নাই। একমাত্র প্রেসিডেন্সি কলেজে নিয়মিত ভাবে রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপনা হইত। লেবরেটরিতে ‘এক্সপেরিমেণ্ট’ (পরীক্ষা) করা হইত। বেসরকারী কলেজের সংখ্যা খুব কম ছিল। এবং তাহাদের তেমন সঙ্গতি না থাকাতে বিজ্ঞান বিভাগ তাহারা খুলিতে পারে নাই। কিন্তু এই সকল কলেজের ছাত্রেরা নামমাত্র “ফি” দিয়া প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞানের ক্লাসে অধ্যাপকের বস্তৃতা শুনিতে পারিত। ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার তাঁহার কতৃক ১৮৭৬ খৃঃ প্রতিষ্ঠিত Indian Association for the Cultivation of Science পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন শাস্ত্রে বস্তৃতার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন এবং সাধারণে ইহাতে নামমাত্র ফি দিয়া যোগ দিতে পারিত। আমার স্মরণ হয়, ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার গভর্ণমেণ্টের নিকট এই মর্মে পত্র লিখেন যে প্রেসিডেন্সি কলেজের বিজ্ঞানের ক্লাশে বেসরকারী কলেজের ছাত্রদের যোগদানের যে ব্যবস্থা আছে তাহা বন্ধ করিয়া দেওয়া হউক নতুবা বিজ্ঞান সমিতির বক্তৃতা-গৃহ শূন্য পড়িয়া থাকিবে। ইহাতে বিজ্ঞান সমিতির উপর কোন দোষারোপ করা হয় নাই, বরং সাধারণ ভারতীয় যুবকদের মনের পরিচয়ই পাওয়া যাইতেছে। পরীক্ষার জন্য যদি কোন পাঠ্য বিষয় নির্দিষ্ট না করা হয়, তবে কোন ছাত্র তাহার জন্য পরিশ্রম করিবে না।গভৰ্ণমেণ্টেরও শীঘ্রই এইরুপ ব্যবস্থা করিতে হইত, কেন না বিজ্ঞান ক্লাশে ছাত্র-সংখ্যা দিন দিন বাড়িতেছিল এবং “বি” কোর্স (বিজ্ঞান) ক্ৰমেই ছাত্রদের নিকট অধিক প্রিয় হইয়া উঠিতেছিল। ”
বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, মহেন্দ্রলাল সরকারের প্রতিষ্ঠিত Indian Association for the Cultivation of Science বিজ্ঞানের একমাত্র এবং বিংশ শতকের অগ্রবর্তী অন্যতম বিজ্ঞান সমিতি হলেও প্রয়োজনীয় উপাদান, যন্ত্রপাতি এবং আনুকূল্যের অভাবে এই অ্যাসোসিয়েশন রয়্যাল ইনস্টিটিউটের মর্যাদা পায়নি বলে মহেন্দ্রলাল সরকারকে অনেক মানসিক যন্ত্রনা এবং দুঃখ বয়ে নিয়ে বেড়াতে হয়েছে।
মহেন্দ্রলাল সরকার : জন্ম, জীবন-কর্ম ও মৃত্যু
সারাজীবন বিজ্ঞান এবং মানবতার চিকিৎসায় উৎসর্গ করা এই চিকিৎসাবিদ ১৮৩৩ সালের ২ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন হাওড়া জেলার পাইকপাড়া গ্রামে। বাবা তারকনাথ সরকার এবং মা অঘোরমণি। দরিদ্র পরিবারের দুইপুত্র এবং এক কন্যার মধ্যে মহেন্দ্রলাল সরকার ছিলেন সবার বড়। মহেন্দ্রলালের বয়স যখন সবে পাঁচ তখন তার বাবাকে চিরবিদায় জানান অনন্তকালের পথে। দরিদ্র পরিবারে পিতার মৃত্যুতে পুরো পরিবার সমস্ত দিক থেকে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লে মহেন্দ্রলালের মা মহেন্দ্রলাল সরকার ও তার ছোটভাইকে লালন পালনের জন্য পাঠিয়ে দেয়া মামার বাড়ি কলকাতায়। আর এখান থেকেই মহেন্দ্রলাল ১৮৪১ সাল ভর্তি হোন কলকাতার হেয়ার স্কুলে। পরবর্তীতে ১৮৪৯ সালে জুনিয়র স্কলারশিপ নিয়ে ভর্তি হোন হিন্দু কলেজে। এখানেই মূলত তার বিজ্ঞানের প্রতি বিশেষ আগ্রহ এবং বিজ্ঞান শিক্ষার মূল ভিত্তি গঠিত হয়। এই হিন্দু কলেজেই তার গাণিতিক, জ্যামিতিক , ত্রিকোণমিতিক এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান তৈরি হয়।
অনেকেরই মতে মহেন্দ্রলালের বুদ্ধিমতা এত প্রখর এবং উচ্চাশিক্ষা অর্জনের স্পৃহা এত বেশি ছিল যে তার জ্ঞান পিপাসা মেটাবার সামর্থ্য হিন্দু কলেজের ছিল না। তার এই উচ্চজ্ঞান অর্জনের স্পৃহা থেকেই তিনি তার হিন্দু কলেজের দুইজন প্রফেসর মহেন্দ্রলালকে হিন্দু কলেজে আরও একবছর পড়বার পরামর্শ দিলেও তিনি তার কোনো প্রকার তোয়াক্কা না করেই ১৮৫৪ সালে ভর্তি হোন কলকাতার মেডিকেল কলেজে। কলকাতা মেডিকেল থেকে ১৮৬৩ সালে স্নাতকোত্তর পাশ করেন তিনি। তিনিই ছিলেন এই প্রতিষ্ঠান থেকে এম ডি (ডক্টর এফ মেডিসিন) ডিগ্রি অর্জন করা দ্বিতীয় ব্যাক্তি। কর্মজীবনের শুরুতে অ্যালোপ্যাথকে তার চিকিৎসা সেবার প্রধান পথ করে নিলেও পরবর্তী তিনি একরকম আকস্মিক ভাবেই হোমিওপ্যাথকে বেছে নেন। হোমিওপ্যাথের এই ঘোরবিরোধী (১৮৬৩ সালে ব্রিটিশ সরকার কতৃক প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন এর বঙ্গীয় শাখার উদ্বোধনের বক্তৃতায় তিনি হোমিওপ্যাথকে হাতুরি চিকিৎসা বলে উপহাস করেছিলেন।) মহেন্দ্রলাল আচমকা সেই পথেই গেলেন। উল্লেখ্য যে, মহেন্দ্রলাল সরকার ব্রিটিশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন এর বঙ্গ শাখার সম্পাদক ছিলেন। বিভিন্ন তথ্য মাধ্যম থেকে বিশেষত, মহেন্দ্রলাল সরকার সম্পাদিত পত্রিকা “ক্যালকাটা জার্নাল অব মেডিসিন” থেকে জানা যায় তার এই চিকিৎসা সেবার পথের মোড় নেবার ইতিহাস।
চিরটাকাল মানব কল্যাণের পথে হাঁটা, তার জন্য পথ তৈরি করে দেয়া এ মানুষটিকেও চিরটাকাল নানান প্রকার প্রতিবন্ধকতা এবং হিংসের বশবর্তী হতে হয়েছে। পেয়েছেন অনেক লাঞ্চনা ও গঞ্জনা। এ উপমহাদেশে বিজ্ঞান সাধনায় যিনি নিরলস এবং নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে গেছেন, যিনিই প্রথম ১৮৭৬ সালে ভারতে বিজ্ঞান সভার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন; তাকেই কিনা কোনো প্রকার যৌক্তিক কারণ ছাড়াই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান সমিতির সিনেট পদ থেকে বিতাড়িত করার চক্রান্ত করা হয়! অবশ্য পরবর্তীতে তিনি নিজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর কে উদ্দ্যেশ্য করে দুটি চিঠি লিখেন এবং পরে ১৮৭৮ সালের এপ্রিলে মহেন্দ্রলাল নিজেই বিজ্ঞান সমিতি থেকে পদত্যাগ করেন। মহেন্দ্রলাল সরকার ১৮৮৮ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন। এই সম্মেলনে অসমের চা শ্রমিকদের দুরবস্থা সম্বন্ধে প্রস্তাব নেয়া হয়। মহেন্দ্রলাল শ্রমিকদের অপমানসূচক ‘কুলি’ শব্দ ব্যবহারে আপত্তি করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো, অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট, কলকাতার শেরিফ (১৮৮৭) এবং বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য ছিলেন। চিরকাল বিজ্ঞান এবং মানবতার সেবায় নিয়োজিত থাকা এই মানুষটি ১৯০৪ সালে অনন্তকালের পথে পাড়ি জমান। সময়ের পরিক্রমায় নানান চাকচিক্যের ভিড়ে তার চিহ্ন মুছে যাচ্ছে আমাদের স্মৃতির সমস্ত পাতা থেকে।
তথ্যসূত্র:
লিখেছেন: বিপ্লব হোসাইন
আরও পড়ুন: লিসে মাইটনার: অবহেলিত নারী বিজ্ঞানীর গল্প!