আয়নার ওপাশে
এক.
দাড়িতে হাত বুলোচ্ছে ইখতিয়ার। পুরো নাম মো. ইখতিয়ার আজিজ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। বিষয় ইংরেজি সাহিত্য। ভার্সিটিতে উঠেই জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আইডি খুলেছিল সে। কিন্তু বছরের গ্লানি টেনে টেনেও প্রসারতা বাড়েনি তার আইডির। হাতে গোনা ২০/৩০ টা লাইক পড়ে প্রতিটা পোস্টে। কমেন্ট, সে তো প্রায় অমাবস্যার চাঁদ। এ নিয়ে হতাশার অন্ত নেই ইখতিয়ারের। সব সময় চিন্তায় ডুবে থাকে সে, কী করা যায়, কী করা যায়!
সৌভাগ্যক্রমে গতকাল তার হাতে পড়েছিল আবুল মনসুর আহমেদের গল্পগ্রন্থ ‘আয়না’। যদিও উচ্চমাধ্যমিকে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর ‘লালসালু’ উপন্যাস আত্মস্থ করেছিল সে। কিন্তু আয়নার গল্পগুলোই তার ভেতরটাকে নাড়িয়ে দিলো। আয়না বইটা নতুন ধার উন্মোচন করল তার সামনে। তার খুব আফসোস হতে থাকল বইটা কেন আগে পায়নি!
কর্ণফুলী নদীর পাড়ে গিয়ে বসল ইখতিয়ার। নদীর শান্ত জল ছলাৎ ছলাৎ শব্দে বয়ে চলেছে বিরামহীন। প্রশান্ত মনে সবকিছু ঠিকঠাক করে নিলো সে। কাল থেকে সে আর ইখতিয়ার আজিজ নয়। তার নতুন পরিচয় ‘জারিফ আহমেদ’। তবে নতুন পরিচয়টা বাস্তব জীবনের নয়, বরং ভার্চুয়াল জগৎ তথা ফেসবুকের।
পাঠক ভাবছেন, ইখতিয়ার এখন লালসালুর মজিদের মতন ফেসবুকে মাজার বানাবে, নাকি আয়নার মতো নিজেই পীর সেজে যাবে? মোটেও না, সেই যুগ আর নেই। যুগ বদলেছে। বদলেছে মানুষের চিন্তাধারাও। এখন চলছে ইন্টারনেট বিপ্লব। ইন্টারনেটের যুগে নতুন বেশভূষাটাও যুগোপযোগী হওয়া উচিত। ইখতিয়ারও অতটা বোকা নয়। সেও যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সব ঠিক করেছে। বাংলাদেশে প্রায় ২ কোটি ফেসবুক ইউজার আছেন। তাদের একটু ভিন্নভাবে কাজে লাগানো কঠিন কিছুই নয়! শুধু আসল জায়গায় একটু সুড়সুড়ি দিতে জানতে হয়। সুড়সুড়ি দেবার মন্ত্র খুব ভালোভাবেই জানে জারিফ ওরফে ইখতিয়ার।
যেই ভাবা সেই কাজ! শুরুতেই ফেসবুক আইডির নাম পরিবর্তন করে ‘জারিফ আহমেদ’ দিলো সে। নাম পরিবর্তনের পরপর নেট থেকে একটা আধপোড়া পবিত্র কোরান শরীফের ছবি ডাউনলোড দিলো। এরপর ছবিটা নিজের আইডিতে পোস্ট দিয়ে, ক্যাপশনে লিখল-
‘দেখুন, কীভাবে উন্মাদপুর গ্রামে পবিত্র কোরান শরীফে আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছে মালাউন হিন্দুরা। আল্লাহ তাদের উপর গজব নাজিল করুন। আমিন।’
(শেয়ার করে খবরটি ছড়িয়ে দিন।)
প্রথম কিস্তিতেই বাজিমাত জারিফের। যে আইডিতে ২০/৩০ টার বেশি লাইক পেত না। সেখানেই এই ছবিতে লাইক, স্যাড রিএক্ট, এংগ্রি রিএক্ট সব মিলিয়ে হাজার ছাড়িয়েছে। শেয়ার হয়েছে প্রায় তিন শতাধিক। কমেন্টও এসেছে পাঁচশোরও বেশি। যে ছেলেটা জীবনে কোরান পড়ে না, সে কমেন্টে গালি দিয়ে হিন্দুদের গুষ্টি উদ্ধার করল। যে ছেলেটা নামাজ-কোরান দূরে থাক, সারাদিন মেয়ে নিয়ে ইটিশ-ফিটিশ আর পর্নোগ্রাফি দেখায় ব্যস্ত থাকে, সে কমেন্ট করেছে- ‘শালা কুত্তার বাচ্চা সব মালাউনের দল! শূয়োরের বাচ্চা!’ যে মেয়েটা সারাদিন ম্যাকাপ ঢলে আর ছেলেদের সাথে ফ্লার্টিং করে, সেও মুরাদ টাকলা ভাষায় লিখেছে, ‘Sab gola amanosar dal..allah tome adar saste dao. hendo ra sab kottar bassa.. ame adar grena kore..!’ এরকম নানান কমেন্টে লালবাত্তি জ্বলল জারিফের আইডিতে। একদিনেই তার ফলোয়ার হলো হাজার খানেক।
এরপর কিছুদিন চুপ থাকল জারিফ। প্রায় সপ্তাহখানেক। যদিও উন্মাদপুর ও উন্মাদপুরের হিন্দুদের কেউই খুঁজে পায়নি। কিন্তু নিজের আশে-পাশের হিন্দুদের উপর প্রতিশোধ নিতে ভুল করল না, জারিফের ফলোয়ার সহিহ মুমিন বান্দারা। কয়েকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়াও যেটা বড় করে হাইলাইট হলো, মাছিমপুরের একটা নিভৃত, শান্তিময় গ্রামে হিন্দুপাড়ায় আক্রমণ ও ঘরবাড়িতে আগুন। চোখের সামনেই বেদ, গীতা থেকে শুরু করে ঘরের সর্বস্ব জ্বলে যেতে দেখল হিন্দুরা। মালামাল বাঁচাতে গিয়ে জানও হারালো কয়েকজন হিন্দু।
কেস হলো, তদন্ত হলো। কিন্তু অনেক খুঁজেও ঘটনার সূত্রপাত আবিষ্কার করা গেল না। এদিকে মিডিয়া জগতে তোলপাড়। মানবতাবাদীরা ইস্যু পেয়ে গর্ত থেকে বেরিয়ে এসেছে। সারাক্ষণ পরিস্থিতি গরম করে রাখছে বিভিন্ন বুলি আউড়িয়ে। এদিকে ভয়ে জারিফ সাময়িকভাবে আইডি ডিএক্টিভেট করে দিলো। বিপদ কখন কোন দিক থেকে আসে বলা যায় না। সাবধানের মার নেই!
অনেকদিন কেটে গেল। এ বিষয়ে কোনো সুরাহা হলো না। মিডিয়া আস্তে আস্তে ঠান্ডা হয়ে এলো। সমস্ত মানবতার বুলিও নেতিয়ে পড়ল আস্তে আস্তে। কেউ ধরা পড়ল না, কারও শাস্তিও হলো না। মাঝখানে জান-মাল আর ঘরহারা হলো একদল শ্রী-কৃষ্ণের অনুসারী। ইস্যু জিনিসটা খুবই আপেক্ষিক ও পরিবর্তনশীল। নতুন নতুন শতশত ইস্যুর ভিড়ে এক সময় হারিয়ে গেল ‘সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর হামলা’ ইস্যুটাও। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আবার আইডি অন করল জারিফ। এবার আরও ইউনিক কিছু চেষ্টা করল সে।
ইন্টারনেট থেকে ভূমধ্য সাগরে জাহাজ ডুবিতে নিহতদের কয়েকটা ছবি ডাউনলোড করে পোস্ট করল। সাথে ক্যাপশন-
‘দক্ষিণ আফ্রিকায় মুসলিম হওয়ার দরুণ, কী হিংস্রভাবে মুসলিম ভাইদেরকে হত্যা করা হচ্ছে দেখুন। আল্লাহ, তুমি জালেমদের থেকে মুসলিম ভাইদেরকে রক্ষা করো। আমিন।’
কয়েকজন স্কুল ফেল, নির্বোধদের কাছে রেসপন্স পেলেও, শিক্ষিত ইউজারদের কারণে জারিফের এই পোস্টটা মাঠে মারা খেল। কারণ যারা পত্র-পত্রিকা, টিভিতে চোখ রাখে, তারা এই বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল। কয়েকজন গুগল ইমেজ সার্চ ব্যবহার করে কমেন্ট বক্সে আসল গোমর ফাঁস করে দেওয়ায়, অগত্যা সেলেব্রেটি সম্মান ট্যাগ বাঁচাতে পোস্টটা ফেসবুক থেকে মুছে দিলো জারিফ।
কিছুদিন বিমর্ষতা নিয়ে কাটালো জারিফ। শেষ ঘটনাটা নিয়ে খুবই আশাহত সে। নতুন কিছু ভাবতে লাগলো। ভাবতে ভাবতে একসময় পেয়েও গেল। নেট থেকে ভাঙন কবলিত একটা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদের ছবি নিয়ে পোস্ট করল। ক্যাপশন –
‘সব জমি ভাঙতে ভাঙতে নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। মসজিদটিকে নদীভাঙন থেকে বাঁচাতে চাইলে কমেন্টে আমিন লিখুন। আর, ১ লাইক = ৫ দোয়া। ১ শেয়ার = ১০০ দোয়া।’
প্রথম প্রথম কিছু মূর্খ ও গর্দভ প্রজাতির প্রাণির কাছ থেকে প্রচুর লাইক কমেন্ট শেয়ার পেল জারিফ। ফলোয়ারও বাড়লো অনেক। শেষে কিছু মডারেট মুসলিমের হাতে পড়ে তুলোধুনো হলো পোস্টটা। আবারও পোস্ট ডিলেট দিতে হলো জারিফকে। এবার রাগে, দুঃখে আবার আইডি ডিএক্টিভ করে দিলো সে।
নিজে নিজে ভাবলো, এভাবে কিছুই হচ্ছে না। দীর্ঘ বিরতি নিয়ে বড় পরিকল্পনা করতে হবে। আর ফাঁকফোকর রাখা যাবে না। এক লাখ ফলোয়ার, দশ হাজার লাইক প্রতি পোস্টে, তার চাই ই চাই। কয়েকমাসের দীর্ঘ বিরতি নিয়ে ঠান্ডা মাথায় রিসার্চ করতে হবে। তা-ই করল জারিফ। কিন্তু কোনো আশানুরূপ ফলাফল আসলো না। আবার হতাশায় ডুবে গেল সে।
দুই.
নিরামিষ দিনগুলোর মধ্যে কোনো একটা সৌভাগ্যময় দিনে জারিফের হাতে মহাসূত্র এসে পড়ল। দুই দুইয়ে মিলিয়ে চার বানাতে কোনো ভুল হলো না জারিফের। সূত্রগুলোর একটা পেয়েছিল বইয়ের দোকানে। হুমায়ূন আজাদের লেখা বই ‘আমার অবিশ্বাস’। আরেকটা সূত্র আরও চমকপ্রদ। সেটা পেয়েছে ইউটিউবে। একজন ডিগ্রীবিহীন কথিত ডাক্তার, ডাক্তারি পেশায় সুবিধা করতে না পেরে লালসালুর মজিদের মতো নেমেছেন বিশ্বাসের ব্যবসায়। তার নাম খাজুর লায়ক। তিনি ডাক্তারি ফেলে বিভিন্ন জায়গায় বাহাস করে বেড়ান, আর টাকা ইনকাম করেন। এছাড়াও বিভিন্ন ফান্ড থেকে টাকা আসে উনার কাছে। ইহুদি নাসারাদের বেশভূষা পরিধান ও নিজের ইচ্ছেমতো কোরান-হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা, আর অসংখ্য মিথ্যাচার করার দরুণ বাংলাদেশের অনেক বড় বড় ও বিখ্যাত দ্বীনদার আলেমগণ এই পাকিস্তানি লোকটাকে পছন্দ করেন না। যেমন: কোরান হাদিস অনুযায়ী প্রমাণিত যে, পৃথিবী সমতল ও চাঁদ সূর্য সবকিছু পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরে। অথচ এই লোক বাহাসে বলে, পৃথিবী গোলাকার, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে। নিজের কথাকে সত্য প্রমাণের জন্য কোরান হাদিসের ভুল অনুবাদ করেন বলে দাবি অনেক আলেমের। এই লোকটা ইহুদি নাসারাদের দালাল ছাড়া কিছুই নয়। সে কোরানের ভুল অনুবাদ করে বুঝায়, চাঁদের নাকি আলো নেই, সূর্য থেকে ধার করে। এমন কথা কী মানা যায়! এদেশের কিছু বিজ্ঞানপ্রেমী আধা ধার্মিক মুসলিমদের কাছে খাজুর লায়ক একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। আবার কিছু সহিহ বিজ্ঞান মনস্ক আধা ধার্মিকের কাছে তিনি মোটেও পছন্দনীয় নয়। কারণ, বাহাসের সময় তিনি নিজের বক্তব্যকে সহিহ প্রমাণ করার জন্য এমন সব বৈজ্ঞানিক থিওরী বলেন, যেগুলো শুনলে নিউটন, আইনস্টাইন, ডারউইন প্রভৃতি বিজ্ঞানীগণ নির্ঘাত আত্মহত্যা করতেন। অজানা কারণে ডারউইন সাহেব সব সময় তার রোষানলে থাকেন। একবার তো ডারউইনকে তুলোধুনো করার জন্য খাজুর সাহেব অনেকগুলো মিথ্যাচারের আশ্রয় নেন তার নামে; সেই সাথে এমন এমন সব বিজ্ঞানীদের নাম ও থিওরী উপস্থাপন করেন যাদের অস্তিত্ব আদতে পৃথিবীতে নেইই। অর্থাৎ পুরোটাই খাজুর সাহেবের কল্পনায় বানানো। কিন্তু বাহাসে উপস্থিত মূর্খ জনতা কিছুই বুঝতে না পেরে উল্টো বাহাবা দিয়েছে। ওপরে ‘আধা ধার্মিক’ শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে মূলত এসব প্রজাতির জন্য, যাদের ধর্মের বিষয়ে কোনো জ্ঞান নেই; অথচ খাজুর সাহেবের বাহাস দেখে দেখে ধর্মের বুলি আউড়ান। তারা ইহুদি নাসারাদের ডিজাইন করা কাপড় পরেন, তাও আবার টাখনুর নিচে, তারা ছবি তোলেন বিভিন্ন স্টাইলে, টিভি দেখেন – হিন্দি সিনেমা (নায়িকার কাপড় ছোট হতে হবে), তারা গান শুনেন – প্রিয় ব্যান্ড এশেজ, শিরোনামহীন! তারা বেগানা নারী-পুরুষ বন্ধুত্ব করেন, প্রেম করেন! তারা কোরান-হাদিস-সিরাত পড়েন না, তাদের শুক্রবার ছাড়া কখনো মসজিদে দেখা যায় না! কিন্তু, ধর্ম ইস্যুতে তারা সদা জাগ্রত! নাস্তিক-কাফের-অবিশ্বাসী-মুরতাদ ইস্যুতে তাদের জেহাদি কাবিলিয়ত বেরিয়ে আসে; তারা গালাগালি-গুষ্ঠি উদ্ধার-কোপাকুপি এসব করে ইমানি দায়িত্ব পালন করেন। এবং তাদের অধিকাংশ জেহাদ ফেসবুক পর্যন্ত সীমাবদ্ধ!
যাই হোক, আমরা জারিফের ঘটনায় ফিরে যাই। কারণ খাজুর সাহেব জাকাত ফান্ডের কয়েক কোটি টাকা মেরে বর্তমানে দেশ থেকে পলাতক আছেন। জারিফ খাজুর সাহেবের বিশাল ফ্যান হয়ে গেল। কিন্তু তার ওভাবে জনসম্মুখে গিয়ে সবার সামনে গুছিয়ে বক্তৃতা দেবার ক্ষমতা নেই। ভিড় দেখলে ভয়ে চুপসে যায় সে। তাই সে ঠিক করল ফেসবুকে লেখালেখিই শুরু করবে সে। এটাও তো একপ্রকার বয়ানই। কিন্তু বয়ান বা বাহাস করবে কী নিয়ে? তার উপায় ‘আমার অবিশ্বাস’ বইটা। হুমায়ূন আজাদ দেশের কুখ্যাত, বিখ্যাত নাস্তিক লেখক। ধর্মের বিরুদ্ধে লিখে বহু কিছু অর্জন করেছেন। যদিও শেষমেষ অন্যদেশে গিয়ে উগ্র বিশ্বাসীদের হাতে পটল তুলেছিলেন। জারিফ বাহাসের বিষয় পেয়ে গেছে। হুমায়ূন আজাদ তথা অন্যান্য নাস্তিকদের বিরুদ্ধে লেখা। এমনিতে গতবছর নাস্তিক ব্লগার, লেখক, প্রকাশককে হত্যার ইস্যুটা বেশ গরম ছিল। এই সময়ে জারিফ এই ইস্যুতে নামলে বিপুল পরিমাণ রেসপন্স পেতে পারে। কারণ ৯০% মুসলিমের এইদেশে অন্তত ৬০/৭০% তো তার পক্ষেই থাকবে। খাজুর লায়কের মতোও সে ভুলভাল লিখলেও ওসবে খেয়াল করার লোক খুবই কম বাংলাদেশে, তা জারিফ ভালোই জানে। দারিদ্র্যপীড়িত এদেশে অধিকাংশ লোকই দিনে দিনে খায়! এদেশে কার এত ঠেকা পড়েছে ধর্মের গভীরে ঢোকার, উৎপত্তি-ইতিহাস জানার। কারই বা ঠেকা পড়েছে বিজ্ঞানচর্চা করার। সারাদিন অমানুষিক কাজকর্ম শেষে বিছানায় গা এলাতে এলাতে স্রষ্টাকে একটু স্মরণ করতে পারলে, বিপদে সেই স্রষ্টাকে ডাকতে পারলেই সবাই খুশি। ইদগুলোতে আনন্দ ভাগাভাগি করেই এদের বেঁচে থাকা।
এমন দেশে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে লিখতে গিয়ে, মিথ্যাচার করলে, অপবিজ্ঞান প্রকাশ করলে; বই পড়ে খুঁজে খুঁজে যে তার ভুল ধরবে, এমন লোক যে নেই বললেই চলে; তা জারিফ ভালোভাবেই জানে। এবারের প্ল্যান বৃথা যাবে না সেটা নিয়ে আশাবাদী জারিফ। আইডি অন করে মিশনে নেমে পড়ল সে। ‘আমার অবিশ্বাস সমীপে’ নাম দিয়ে সিরিজ আকারে লেখা শুরু করল। ভার্সিটির নবীন-প্রবীণ অসংখ্য ভাইবোন, ব্লগার হত্যার নেপথ্য ঘাটতে গিয়ে অনেকেই অবিশ্বাসী কিংবা সংশয়বাদী হয়ে পড়ছিল, নিহতদের লেখা পড়ে পড়ে। তাদের আলোর পথ দেখাতে শুরু করল জারিফের লেখা। অনেকেই এবার জারিফের মুরিদ হতে শুরু করল।
তিন.
বিশ্বাসের জায়গাটা খুবই স্পর্শকাতর। এখানে সুড়সুড়ি দিলে ধনাত্মক, ঋণাত্মক যেকোনো প্রভাবক ফুঁসে উঠতে পারে। জারিফের ক্ষেত্রে ধনাত্মক হলো। লাইক, কমেন্ট, শেয়ারের বন্যায় ভেসে গেল তার টাইমলাইন। এক লাখ ফলোয়ার হতে মাত্র তিন-চার মাস লাগলো তার। এখন তার পোস্টে দশ হাজারেরও বেশি লাইক পড়ে। তার ফ্যান পেজ খোলা হয়ে গেছে, ফ্যানদের জন্য খোলা হয়েছে ফ্যান গ্রুপও। এসব কিছুর জন্য তার অবশ্য কম কষ্ট করতে হয়নি। অনেকগুলো বই পড়তে হয়েছে, খাজুর সাহেবের প্রত্যেকটা ভিডিও দেখতে হয়েছে, তারপর আবার খাজুর সাহেবের বক্তব্যগুলো নিজের মতো গল্পাকারে কপি-পেস্ট করতে হয়েছে; এছাড়াও উইকিপিডিয়া ঘাটতে হয়েছে, অনেক বৈজ্ঞানিক জার্নালে খোঁজ রাখতে হয়েছে, কারণ নতুন কিছু পেলেই সেটা যেকোনো ভাবে তার পোস্টে অ্যাড করতে হতো। আর কোনো সমীকরণ মেলাতে না পারলে নিজের মতো করে গোঁজামিল দিয়ে মেলাতে হতো। এটাও কম কষ্টের ছিল না।
সে এখন আর সেলেব্রেটি হবার জন্য এসব করছে ভাবে না, মনে মনে ভাবে, দ্বীনের সেবাতেই এসব করছে। কিন্তু কিছুদিন পর নার্সিসিজম পেয়ে বসে জারিফকে। সে এতটাই অহংকারী হয়ে উঠে যে মাঝে মাঝে নিজেকে একজন নবির সমকক্ষ জ্ঞান করে পোস্ট করে ফেলে। কিন্তু তার নির্বোধ ফ্যানদের ঘিলুতে এসব ঢুকে না। কারণ, তাদের ধর্মের জ্ঞান কিংবা বাস্তবিক জ্ঞান কিছুই নেই। দুয়েকজন প্রশ্ন তুললেও সংখ্যাগরিষ্ঠের চাপে তারা পিষ্ট হয়ে যায়। পোস্টে জারিফের বিরুদ্ধে কেউ কমেন্ট করলে, তার ফ্যানরা তাকে ধুয়ে দেয়। কমেন্ট যদি অনেক শক্তিশালী যুক্তির হয় তবে জারিফ তা মুছে দেয়। বিশাল সৈন্যবাহিনি নিয়ে সে ভার্চুয়ালে একছত্র রাজত্ব করতে থাকে।
অনেকদিন কেটে যায়। এর মাঝে একদিন এক অখ্যাত প্রকাশকের চোখ পড়ে জারিফের আইডিতে। তার ‘বোকাসু’ প্রকাশনী অনেকদিন যাবত সাহিত্যের বই টই প্রকাশ করে নাম করতে পারছিল না। জারিফের আইডি দেখে বুদ্ধি খেলে যায় প্রকাশক আক্কাস আলীর মাথায়। বিশ্বাস বাজারে জারিফের সহকারী ব্যবসায়ী হতে পারলে লালে লাল হয়ে যাবে সে। প্রস্তাবটা নিজে থেকেই সাধে আক্কাস আলী। জারিফ গভীর চিন্তায় পড়ে। শেষে ভেবে দেখে, ফেসবুকে এসব করে খুব একটা লাভ তো হয়নি, সেলেব্রেটি হওয়া ছাড়া! তার সৈন্যবাহিনীকে কাজে লাগিয়ে পকেট মোটা করলে মন্দ হয় না। ‘হ্যাঁ’ বলে দেয় সে আক্কাস আলীকে। শুরু হয় যথেষ্ট গতিতে প্রথম বইয়ের কাজ। জারিফের ফেসবুকের লেখাগুলো বই আকারে প্রকাশ করছে আক্কাস আলী। জারিফ মনে মনে পুলকিত হয়। সে কল্পনাও করেনি যে, হুট করে বাস্তব লেখক বনে যাবে নিজে।
আক্কাস সাহেবের প্ল্যান, মোটেও বৃথা যায়নি। দ্বীনের সেবার নামে বিশ্বাসের ব্যবসা চলেছে হুরুস্থুলভাবেই। যেখানে বইমেলাতে অনেক ভালো কোয়ালিটির বই ৫০০ কপি ছাপানো হয় প্রথম মুদ্রণে, সেখানে জারিফের বই প্রথম মুদ্রণ ছাপানো হয়েছিল ৫০০০ কপি। তার মধ্যে প্রথম দিনের প্রি অর্ডারেই শেষ ৩০০০ কপি। পুরো মেলা জুড়ে চলল জারিফের বইয়ের জমজমাট ব্যবসা। বাংলাদেশের সমস্ত রেকর্ড ভঙ্গ করে বইটার বিক্রি ছাড়িয়ে গেল ২০/৩০ হাজার কপি প্রায়। সেই সাথে নামধামহীন প্রকাশক আক্কাস আলী ও লেখক জারিফ আহমেদের পকেটে ঢুকে গেল ৩০ লাখেরও বেশি টাকা। আক্কাস আলী প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না, সত্যিই এমনটা ঘটেছে। এটা তার কল্পনার চেয়েও বেশি। আস্তিক-নাস্তিক, মুমিন-বিধর্মী সকলেই কিনেছিল বইটা। কেউ বুঝে, কেউ অন্ধ বিশ্বাস থেকে, কেউ হুজুগের বশে, আবার কেউ সমালোচনার জন্য। বাঙালি জাতিটা আসলেই ভীষণ হুজুগে। নেগেটিভ মার্কেটিং বড় প্রভাব ফেলেছিল জারিফের বইটাতে।
চার.
মেলার সিজন তখন শেষ। জারিফ দ্বিতীয় বই লেখায় ব্যস্ত। সে এখন হুমায়ুন আহমেদ, হুমায়ূন আজাদ, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, সেলিনা হোসেন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, প্রমুখ সবাইকে টপকিয়ে; বাংলাদেশের লেখক তালিকায় শীর্ষে। অবশ্য লেখার মানে নয়, বরং বইয়ের কাটতিতে। এদিকে তার প্রথম বই ‘আমার অবিশ্বাস সমীপে’ নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা চলছেই। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তার।
এরই মাঝে একদিন এক ছেলে তাকে ট্যাগ দিয়ে একটা পোস্ট করল। পোস্টে ছেলেটা দেখাল, জারিফ মাত্র এক পৃষ্ঠায় ৬ টা মেজর বৈজ্ঞানিক ভুল করেছে তার প্রথম বইয়ে। সেগুলো আবার ক্লাস সিক্স-সেভেন লেভেলের বিজ্ঞান বিষয়ক পড়া। ছেলেটা তাই সেগুলো নিয়ে অনেক কটাক্ষ করল। জারিফ ছেলেটার পোস্টের কোনো প্রতিউত্তর করল না। চুপচাপ কমেন্ট বক্স দেখে যেতে থাকল, কীভাবে তার মুরিদরা ছেলেটাকে ধুয়ে দিচ্ছে! তার মুরিদরা কেউই জানে না, কিংবা জানলেও বোঝার চেষ্টা করে না যে, বইটা খাজুর সাহেবের স্টাইলে লেখা। গল্পের নায়ককে জেতাতে জারিফের অনেক মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়েছে, মনগড়া বানিয়ে লিখতে হয়েছে। তারমধ্যে অনেক কিছু আবার ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের পরিপন্থী!
ছেলেটার একটা কমেন্টে চোখ আটকে যায় জারিফের।
‘আপনারা নিশ্চয় একটা হাদিস জানেন। যেখানে নবিজি হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, মুনাফিকের তিনটি চিহ্ন – ১. ওয়াদা ভঙ্গ করে। ২. মিথ্যা বলে। ৩. আমানতের খেয়ানত করে। এই হাদিস অনুযায়ী জারিফও একজন মুনাফিক। কারণ সে ধর্ম ও বিজ্ঞানের নামে উচ্চমার্গীয়ভাবে মিথ্যাচার করেছে। আরেকটা জিনিস কোরান হাদিসে যেখানে- বিধর্মীদের বন্ধু না বানাতে, তাদের অনুসরণ না করতে বলা হয়েছে। এছাড়াও নাস্তিক মুরতাদদের হত্যা করতে বলা হয়েছে। সেখানে একজন নাস্তিকের বানানো সাইটে এসে এরকম লাফালাফি আর বিশ্বাসের ব্যবসা করাটা নিতান্তই ভন্ডামি ছাড়া কিছুই নয়। লালসালুর মজিদরা স্বার্থসিদ্ধির লোভে যুগে যুগে থাকবে স্বাভাবিকই। যেমন: ইন্টারনেটের যুগে জারিফ আহমেদরা!’
এই মন্তব্য পড়ে জারিফের মুরিদরা আরও বেশি গালিগালি ও ধোয়া শুরু করে ছেলেটিকে। কিন্তু জারিফ তব্দা খেয়ে যায়। কমেন্টের কথাগুলো মস্তিস্কের নিউরণে আলোড়ন তোলে তার।
পরের দিন সকালে, আবার কর্ণফুলী নদীর পাড়ে বসে আছে জারিফ। শীতল, কুয়াশাচ্ছন্ন পানি ছলাৎ ছলাৎ শব্দে এগিয়ে যাচ্ছে। ঢেউ তুলছে জারিফের বুকের ভেতর। হাতে দৈনিক পত্রিকা। প্রথম পাতার এক কোনে ছোট্ট শিরোনাম, ‘অজ্ঞাতদের ধারালো অস্ত্রের কোপে বামপন্থী ঢাবি শিক্ষার্থী নিহত!’ এটা সেই ছেলেটা, যে জারিফকে ট্যাগ করে পোস্ট দিয়েছিল। জারিফের হৃৎপিণ্ডটা ধুকপুক করে কেঁপে ওঠল। কথিত এবং সবার সম্মুখে পুরোপুরি প্র্যাকটিসিং মুসলিম হলেও, ধর্মকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারেনি সে। কারণ, ধর্মের উৎপত্তি-ইতিহাস সম্পর্কে অন্যদের চেয়ে বেশিই জানে সে। ছেলেটার শেষ মন্তব্যটা মনে পড়ল তার। সত্যিই তো, ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ একজন ইহুদি এবং পরবর্তীতে নাস্তিক। তারই বানানো সাইটে জারিফ দ্বীনের দাওয়াতের নামে করছে নিজের স্বার্থ হাসিল। ‘যদি ধর্ম সত্য হয়ে যায়? যদি মৃত্যুর পর দেখে সত্যিই পরকাল আছে? তখন স্রষ্টার কাছে এসব কাজের জন্য কী জবাব দেবে সে? স্রষ্টা যদি সুবিচারক হয়ে থাকেন তবে তো কোনোভাবেই তার মুক্তি নেই! শাস্তির হাত থেকে কীভাবে সে রক্ষা পাবে?’ এসব ভাবতে ভাবতে জারিফ শিউরে ওঠে। তার রক্ত শীতল হয়ে, লোমগুলো খাড়া হয়ে যায়। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে সে নদীর জলের দিকে তাকায়। জলে আয়নার মতো তার প্রতিবিম্ব সৃষ্টি হয়েছে। পানির ঢেউয়ে তার চেহারাটা বিভৎস লাগছে! মুখোশের আড়াল থেকে জেগে ওঠছে একটা ভয়ানক পশুর অবয়ব।
‘ আয়নার ওপাশে ‘ | © আবুল হাসনাত বাঁধন
তারিখ: (১৩/০২/২০১৮)
স্থান: লঞ্চের ডেক, ঢাকার পথে।
আরও পড়ুন: পেডোফিলিয়া : শিশুদের প্রতি যৌন আসক্তি!