ডেঙ্গু প্রতিরোধে হারপিক ও ব্লিচিং পাউডার মিক্স প্রসঙ্গ:
গত কয়েকদিন ধরে একটা পোস্ট কিংবা ম্যাসেজ পুরো ফেসবুক জুড়ে ভাইরাল। ওই লেখাতে সবাইকে আহ্বান করা হচ্ছে, ডেঙ্গু প্রতিরোধে আগামী শুক্রবার সবাই যেন একযোগে বেসিনে ৫০০ এমএল হারপিক ও ৫০০ এমএল ব্লিচিং পাউডার ঢেলে দেয়। তাদের দাবি এতে সুয়ারেজে থাকা সকল ডেঙ্গুর লার্ভা ধ্বংস হয়ে যাবে। এটা কে বা কারা ফেসবুকে ছড়িয়েছে, কেন কী উদ্দেশ্যে ছড়িয়েছে তা জানা যায়নি! নিচে ম্যাসেজটির ছবি দেখুন!
এবার আসি আসল কথায়, এই বিষয়টি সত্য নাকি গুজব? উত্তর: এটা একদম ১০০% ভুয়া এবং গুজব। তা ছাড়া বিষয়টা আমাদের জন্যে বেশ ভয়ংকরও বটে! এই বিষয়টাকে বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করা যাক!
- হারপিক হলো টয়লেট ক্লিনার যেটা ১০% হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড (HCl) , বিউটাইল ওলেল্যামিন (CHNH) ও অন্যান্য জলীয় দ্রবণ দিয়ে তৈরি। অন্যদিকে ব্লিচিং পাউডার হলো ক্যালসিয়াম হাইপোক্লোরাইট {Ca(OH)2.}Cl. এই দুইটি যদি কেউ মিক্স করে বিক্রিয়া ঘটান তাহলে এর থেকে ক্ষতিকারক ও বিষাক্ত ক্লোরিন (Cl) গ্যাস উৎপন্ন হয়। এই ক্লোরিন (Cl) গ্যাস মানুষের শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক! এমনকি সামান্য পরিমাণ ক্লোরিন (Cl) গ্যাসও আমাদের চোখে জ্বালা, শ্বাসকষ্ট আর ফুসফুসে সমস্যা তৈরী করতে পারে! সেই জায়গায় আপনি যদি ৫০০ এমএল হারপিকের সাথে যদি ৫০০ এমএল ব্লিচিং পাউডার মেশান তাহলে কী অবস্থা হবে বুঝতে পারছেন? ৩০ সেকেন্ডের মধ্যের পুরো ঘর বিষাক্ত ক্লোরিন (Cl) গ্যাসে ভর্তি হয়ে যাবে। আর আপনারা যদি নিশ্বাসের সাথে সেই গ্যাসে টেনে শরীরে ঢুকান, তাহলে আপনার ফুসফুস ৭-৮ ঘণ্টার জন্য স্বাভাবিক কাজ করা, অক্সিজেন সরবরাহ করা বন্ধ করে দেবে! দ্রুত হাসপাতালে না গেলে আপনি ও আপনার বাসার লোকজনদের কিছুক্ষণের মধ্যে মৃত্যুও ঘটতে পারে! [1]
- ড্রেন, ডোবা-নালা ইত্যাদির ময়লা পানিতে ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী অ্যাডিস মশা জন্মে, এটাও আসলে ভুয়া কথা। অ্যাডিস মশা আসলে স্বচ্ছ পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে! তাই এই যে লার্ভা ধ্বংস করার বিষয়টাও অবৈজ্ঞানিক, ভুয়া ও গুজব। [2]
- সত্যি সত্যি যদি অনেকে মিলে ম্যাসেজের কথাটার মতো কাজ করে, তাহলে শুধু যে তারা ও তাদের পরিবারের মানুষ মরবে তা কিন্তু হয়, কল্লাকাটা গুজবের মতো এটাও যদি ছড়িয়ে যায়, তাহলে পুরো একটা শহর, এমনি আমাদের পুরো বাংলাদেশও ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এর দীর্ঘমেয়াদী প্রতিক্রিয়াও আছে! হিসেব করুন, মাত্র ১০০ জনও যদি এই কাজ করে, তাহলেও ১০০ কেজি বিষাক্ত দ্রবণ তৈরী হয়ে যাবে! আর আমাদের শহরের পানি নিষ্কাশন টানেল বা নালা গুলো সব শেষ পর্যন্ত নদীতে গিয়ে মিশেছে! ফলে এই বিষাক্ত দ্রবণগুলো শেষমেষ নদীতে গিয়ে মিশবে। এতে জলজ জীববৈচিত্র্য বা ইকো সিস্টেম নষ্ট হয়ে যেতে পারে, লাখ লাখ মাছ মরে যাবে (যেগুলো বেঁচে থাকবে, ওগুলোও বিষাক্ত হয়ে যাবে), বাংলাদেশের পুরো ওয়াটার সাইকেল বেশ কয়েকমাসের জন্য ব্যবহার অযোগ্য হয়ে যেতে পারে। আমরা বিষাক্ত মাছ খেয়ে খেয়ে মরব কিংবা লং টার্ম ডিজিজে ভুগব। নদীপ্রধান অঞ্চলের মানুষগুলোর অবস্থা হবে আরও করুণ! কী ভয়াবহ অবস্থা হতে পারে কল্পনা-ই করা যাচ্ছে না!
কিছুদিন আগে দেশে গুজব ছড়িয়েছিল, পদ্মাসেতুতে মানুষের কল্লা লাগছে! সেই গুজবে আক্রান্ত হয়েছে দেশের শিক্ষিত-অশিক্ষত পুরো সমাজ! কল্লাকাটা গুজবের জন্য প্রাণও হারাতে হয়েছে অনেক জন নিরীহ মা-বাবাকে! কিন্তু এবারের এই হারপিক ও ব্লিচিং পাউডার গুজব আরও বেশি ভয়ংকর, আত্মঘাতীও বটে! এটা দিয়ে দেশের মানুষ নিজেরা নিজেদের মারার পাশাপাশি, পুরো শহর কিংবা পুরো দেশ ধ্বংস করে দিতে পারে! এক জন দুজন নয়, হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটাতে পারে!
আরও একটা বিষয়, কে বা কারা এসব গুজব ছড়াচ্ছে তাও খতিয়ে দেখা উচিত। এগুলো কি আদতে অজ্ঞতার ফলে অনুর্বর মস্তিস্ক থেকে বের হওয়া ফসল? নাকি ঠান্ডা মস্তিস্কের কেউ ইন্টেনশনালি বপন করেছে আমাদের বিরুদ্ধে?
বিজ্ঞানের অনগ্রসরতা আমাদের আজ এই জায়গায় এনে ধার করিয়েছে! আজ যদি আমাদের বিজ্ঞানের সঠিক জ্ঞান থাকত, আমরা যদি রসায়ন বুঝতাম, তাহলে এই গুজব ডাল-পালা মেলতে পারত না। যাইহোক, এখন আমাদের সকলের উচিত মানুষকে, শহরকে ও দেশকে এই গুজবটা থেকে রক্ষা করা। সবাইকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলা, ধর্মীয় উপসনালয়গুলোতে এ বিষয়ে মাইকিং করে সতর্ক করা, স্যোশাল মিডিয়াতেও সবাইকে সতর্ক করা! আর সরকারেরও উচিত দ্রুত প্রজ্ঞাপন জারি করা, সবার ফোনে ম্যাসেজ পাঠিয়ে সতর্ক করা!
এই শহর, এই দেশ তো আমাদেরই, বাঁচাতেও হবে আমাদেরকেই!
তথ্যসূত্র:
আরও পড়ুন: পানি পড়া – তেল পড়া কীভাবে কাজ করে? – placebo effect