মেয়ার এক্সপোজার ইফেক্ট বোঝার আগে আমাদের ফিরে যেতে হবে সঙ্গীত জগতের অতীতে! গত বিশ-পচিশ বছরে আমাদের দেশে এবং গোটা পৃথিবীতেই সঙ্গীতে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। এমন কিছু পরিবর্তন যা হয়তো বর্তমান প্রজন্ম বুঝতে পারছে না।
সেই ১৯৬৬ সালের কথা। বিটলসরের চারজন সদস্য মিলে ৩৩৩ ঘণ্টা সময় লাগিয়ে রেকর্ড করেছিলেন তাদের অষ্টম স্টুটিও অ্যালবাম ‘সার্জেন্ট পিপার’স লোনলি হার্টস ক্লাব’। এটি গোটা পৃথিবীতে প্রায় ৩২ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছিল! অনেকের মতে এটিই পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে সেরা অ্যালবাম।প্রতিটি গান নিখুঁত ভাবে রেকর্ড করেছিলেন বিটলস সদস্যরা। প্রতিটি মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট বাজানো হয়েছিল একদম মাপা-মাপাভাবে। এই অ্যালবামটি রেকর্ড করার আগে তারা প্রায় তিন বছর সময় নিয়ে নিজেদের প্রস্তুত করেছিলেন।
সেই অ্যালবামের গানগুলো এখনও অনেকেই শোনেন! এখনো সেগুলোকে মানুষ মনে রেখেছে! যেখানে আগের ব্যান্ডগুলো এবং শিল্পীরা কয়েক বছর সময় নিয়ে নিজেদের অ্যালবাম তৈরী করতেন সেখানে বর্তমান শিল্পীরা এবং ব্যান্ডগুলো কীভাবে কয়েক মাসের মধ্যেই সব করে ফেলছেন? এত জনপ্রিয়তা পাওয়ার পরেও কেন কয়েক বছর পর তাদের গানগুলো হারিয়ে যায়? কেন সেগুলোর জনপ্রিয়তাতে ভাটা পড়ে? যেখানে পুরোনো অনেক গান এখনো প্রচুর জনপ্রিয়!
আমাদের বাংলা গানগুলোর দিকেই তাকান। অঞ্জন দত্তের ‘বেলা বোস’, ‘মালা’ কিংবা আমাদের দেশের আব্দুল জব্বারের ‘ওরে নীল দরিয়া’ গানটির মতো জনপ্রিয় গান এখনকার শিল্পীরা কেন করতে পারছে না? কেন তাদের গানগুলো একটা সীমিত সময়ের জন্য জনপ্রিয় থাকে?
হ্যাঁ, এটা সত্য যে আগেকার শিল্পীরা অনেক এক্সপেরিমেন্টাল কাজ করতেন। যেটা হয়তো বর্তমান শিল্পীরা করছেন না। আবার বিটলসে ফিরে যাই। ১৯৬৭ সালে রিলিজ হওয়া তাদের বিখ্যাত গান ‘অ্যা ডে ইন লাইফ’। পাঁচ মিনিটের এই গানটিতে বিটলস সদস্যদের সাথে প্রায় চল্লিশজনের একটা অর্কেস্ট্রা দল বাজিয়েছিল। পাঁচ মিনিটের এই গানটিতে পিয়ানো ছিল, হার্প ছিল, বাঁশি ছিল, ডাবল বেইজ ছিল! আর ব্যান্ডের সদস্যের বাজানো ইন্সট্রুমেন্টগুলো তো ছিলই!
এমন কাজ এখন কেন হচ্ছে না?
আপনার মা-বাবা যদি আপনাকে বলে থাকেন যে ‘সঙ্গীত মারা যাচ্ছে’, তবে সম্ভবত তারা ঠিকই বলেছেন! বিজ্ঞানের এই একটা শাখা এই ব্যাপারে তাদের সাথে একমত। অনেকে সফটওয়্যারের কথা বলবেন। হ্যাঁ সেটা অবশ্যই, সফটওয়্যারের কারণে সঙ্গীতের যথেষ্ট ক্ষতি হয়ে গেছে গত কয়েক দশকে। গলাকে বিকৃত করা এবং তার মধ্যে নানান ধরনের ইফেক্ট দেওয়াটা এখন নিত্য নৈমত্তিক ব্যাপার।
সাধারণ গানের কথা বাদ দিন। আপনি যদি রক বা হেভিমেটাল ফ্যান হয়ে থাকেন যেসব গানে ইন্সট্রুমেন্টগুলোর শব্দের বিশুদ্ধটা একটা ব্যাপার সেখানেও এই সফটওয়্যার ব্যাপারটা এসে যাচ্ছে! অনেকে তো ইন্সট্রুমেন্ট না বাজিয়েই শুধু সফটওয়্যারে প্রোগ্রাম করে নিচ্ছেন!
মোট কথা সফটওয়্যার সঙ্গীতের সৃষ্টিশীলতাকে হত্যা করছে।
তবে ভালো গান না হওয়ার কারণ কিন্তু সফটওয়্যার নয়! এর পিছনে দায়ী অন্যকিছু! অনেক বড় একটা কিছু, সেটা একটা অদ্ভুত পদ্ধতি! একটা কর্পোরেট পদ্ধতি। আচ্ছা, একবার চিন্তা করে দেখুন তো, এখন যে গানগুলো জনপ্রিয় হয়, সেগুলো আপনি প্রথম কোথায় শুনেছেন?
রাস্তাতে, দোকানে কিংবা শপিংমলে, তাই না? এটাই কিন্তু ব্যাপার। আর এই ব্যাপারটা কিন্তু কাকতালীয় নয়! এটা আগে থেকেই পরিকল্পনা করা।
এইখানে অ্যালবাম বের করা প্রতিষ্ঠানগুলো একটা বিশেষ পদ্ধতিতে কাজ করে, আর সেটাই হলো মেয়ার এক্সপোজার ইফেক্ট (The mere-exposure effect)। এই ইফেক্টটা হলো একটা বিশেষ পদ্ধতি।
মেয়ার এক্সপোজার ইফেক্ট কীভাবে কাজ করে?
ধরুন, দুটো জিনিসের ব্যাপারে আপনার কোনো ধারণাই নেই। সেগুলোর মধ্যে কোনটা ভালো কিংবা খারাপ এগুলো আপনি জানেন না। এখন আপনি কোনটা নেবেন? আপনি সেটাই নেবেন যেটা আগে থেকে পরিচিত কিংবা যেটার ব্যাপারে আপনি শুনেছেন আগে, কারও কাছ থেকে, তাই না?
এই যে দোকানে এবং শপিংমনে বারবার নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গানগুলো আপনাকে শুনতে হয় এটা আপনার মস্তিষ্ককে একটা বিশেষ ইঙ্গিত দেয়।
একবার ভেবে দেখুন তো, নতুন যে গানটি আপনার প্লেলিস্টে ওপরের দিকে অবস্থান করছে সেটা কি প্রথমবার যখন আপনি শুনেছিলেন, তখন আপনার ভালো লেগেছিল? উত্তর যদি ‘না’ হয় তবে আপনার ওপরে মেয়ার এক্সপোজার ইফেক্ট কাজ করেছে!
এই গানটা আপনাকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে একাধিকবার শুনতে হয়েছে! কখনো রেস্টুর্যান্টে, কখনো শপিংমলে কিংবা কখনো দোকানে! আর এর ফলেই এক সময়ে গানটা আপনার কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছে। আর এর ফলে যে ভালো লাগা সৃষ্টি হয়েছে তা কিন্তু সেই গানটার প্রতি ভালোলাগা নয়! বরং পরিচিত জিনিসের প্রতি একধরনের আস্থা আরকি!
আর এটা গোটা পৃথিবীতেই চলছে! এভাবেই চলছে পৃথিবীর সঙ্গীত। আর নিয়ে বিজ্ঞজনেরা কিন্তু রীতিমত শঙ্কিত! তাঁদের মতে সঙ্গীতকে গলা টিপে মেরে ফেলা হচ্ছে! আর এভাবেই যে তরুণদের কাছে এককালে বব ডিলান আদর্শ ছিলেন তাদের কাছে আজকে আদর্শ হয়ে গেছেন ব্রিটনি স্পিয়ার্স! এককালে যে ছেলেগুলো লেড জ্যাপলিন শুনতো তাদের বংশধরেরাই আজ শোনে ‘লেডি গাগা’।
এখানে কোনো শিল্পীকে ছোট করাটা উদ্দেশ্য নয়। মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দ থাকতেই পারে। কিন্তু তারপরেও মেয়ার এক্সপোজার ইফেক্ট কিন্তু আপনার ব্যক্তিগত পছন্দকেও প্রভাবিত করতে পারে। মেয়ার এক্সপোজার ইফেক্ট আমাদের মস্তিষ্ককে অভ্যস্ত করে তুলেছে কম জটিল গানগুলোকে শুনতে। সেই গানগুলো যেগুলোতে সফটওয়্যার দিয়েই সবকিছু করা হয়েছে।
পৃথিবীতে অনেক মেধাবী শিল্পী এবং ব্যান্ড আছে যারা এখনো অর্গানিক মিউজিক করে যাচ্ছেন। কিন্তু মেয়ার এক্সপোজারের শিকার আমাদের কান যখন তাদের গান শোনে তখন সেগুলোকে আমাদের কাছে জটিল মনে হয়। কারণ মেয়ার এক্সপোজার ইফেক্ট আপনার কানকে বুঝিয়ে দিয়েছে সফটওয়্যারের মাধ্যমে সৃষ্ট সঙ্গীত অনেক মধুর যেখানে ইনস্ট্রুমেন্টের শব্দকে আপনার কাছে মনে হতে পারে ‘শব্দদূষণ’।
গোটা পৃথিবীতেই অডিও বাজারে চরম মন্দা চলছে। কিন্তু মেয়ার এক্সপোজারকে কাজে লাগিয়ে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকই তাদের লেবেল থেকে বের হওয়া গানগুলোকে জনপ্রিয় করে তুলছে। ঠিক এভাবেই মেয়ার এক্সপোজার ইফেক্ট প্রতি মূহুর্তে সঙ্গীতের কফিনে একটা একটা করে পেরেক ঠুকে চলেছে।
তথ্যসূত্র:
১. এনসাইক্লোপিডিয়া
২. ইউটিউব
আরও পড়ুন: ক্ষুদ্র প্রাণিরাই টিকে থাকবে আগামী শতাব্দীতে!