আমার খুব মনে আছে ক্লাস থ্রিতে যখন আমি পড়ি তখন ভিডিও গেইম নামক জিনিসটা দেখেছিলাম । যেদিন বন্ধুর হাতে সেইটা দেখি সেদিন রাতে আমি আর ঘুমোতে পারিনি । পরেরদিন বাড়ি মাথায় তুলেছিলাম সেই ভিডিও গেমের জন্য। আজ ২০১৯ সালে এসে মানুষ থ্রিডি গেইম খেলে । অর্থ্যাৎ আপনি যেভাবে হাত পা নাড়াবেন স্ক্রিনে থাকা সেই প্লেয়ারটি তেমনই হাত-পা নাড়াবে। এ তো গেলো হাত পা দিয়ে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ এর কাজ। এমন যদি হতো আমি যা কষ্ট করে লিখছি সেইটা ভাবতে ভাবতেই লেখা হয়ে যাবে তাহলে কেমন হতো!
আমার থেকেও এই প্রযুক্তির অভাব সবচেয়ে বেশি যে বোধ করেছেন সে হচ্ছে স্টিফেন হকিং। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি হারিয়েও তিনি লিখেছেন A Brief History of Time এর মতো বই। ১৯৮৫ সালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি হারানোর পর ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক কোম্পানি ‘স্পিচ প্লাস’-এর ‘ইকুয়ালাইজার’ নামক একটি কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে তিনি সাধারণ লেখালেখি ও যোগাযোগের কাজটি করতেন। প্রোগ্রামটি রিমোটের মতো ছোট কন্ট্রোলারের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় শব্দ বাছাই করে হ্যান্ড ক্লিকারের সাহায্যে কম্পিউটারকে নির্দেশ করে হুইল চেয়ার নাড়ানো ও লেখালেখির সুবিধা দিয়েছিল।
১৯৯৩ সালের দিকে ইন্টেল স্টিফেন হকিংয়ের জন্য নতুন একটি সিস্টেম ডিজাইন করে, যেটি লেখালেখি সহ টেক্সট-টু-স্পিচ জেনারেটিং ফিচারের মাধ্যমে কথা বলা, লেকচার দেওয়ার কাজটিও করতে সক্ষম ছিল।
সিস্টেমটি চশমার সাথে সংযুক্ত ইনফ্রারেড সুইচের মাধ্যমে সামনে থাকা কম্পিউটার স্ক্রিনে নির্দিষ্ট বর্ণের কলামে প্রয়োজনীয় শব্দটি খুঁজে বের করে ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়। পুরো কাজটি সম্পাদনের জন্য স্টিফেন হকিংকে গালের মাংসপেশি সামান্য নাড়াতে হতো। এই পদ্ধতিতে মাঝে মাঝে একটি শব্দ খুঁজে বের করার জন্য মিনিটখানেক বেশি সময়ও লেগে যেত। যদি ব্রেইন দ্বারা কম্পিউটারকে নিয়ন্রণ করা যেতো তবে অবশ্যই এটা দ্বারা তিনি কাজ করতে পারতেন।
এটা কি সম্ভব ?
কম্পিউটার হলো প্ল্যাস্টিক, ট্র্যানজিস্টর, আইসি ইত্যাদির সমন্বয়ে তৈরি ইলেকট্রনিক্স ডিভাইজ, কিন্তু মানুষের ব্রেইন জীবন্ত জিনিস; যেটা ১০০ বিলিয়নের মতো অসংখ্য ক্ষুদ্র কোষ দ্বারা গঠিত যাকে নিউরন বলা হয়, প্রত্যেকটি স্নায়ু কোষ একে অপরের সাথে ডেনড্রাইটস (Dendrites) এবং আক্সন (Axon) দ্বারা কানেক্টেড থাকে।
এখানে স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে যে, কম্পিউটার এবং ব্রেইন সম্পূর্ণ আলাদা গঠনের জিনিস। কিন্তু ব্রেইনের কাজ করার ধরণ অনেকটা কম্পিউটারের মতোই। আমরা যখন কথা বলি, কাজ করি, ভাবি, বা যেকোনো কিছু করি —সেটাকে সম্পূর্ণ করার জন্য নিউরন কাজ করে। আর এই কাজ করার সময় নিউরন এক ধরনের ইলেকট্রিক সিগন্যাল তৈরি করে এবং সেটা নিউরন থেকে নিউরনে শেয়ার হয়। আর আপনারা নিশ্চয় জানেন যে, ইলেকট্রনিক্সও ইলেকট্রিক সিগন্যালের উপর কাজ করে। এই ইলেকট্রিক সিগন্যালের উপর ভিত্তি করেই ব্রেইনকে কম্পিউটারের সাথে বা কম্পিউটারকে ব্রেইনের সাথে কানেক্টেড করা সম্ভব। আর্টিফিশিয়াল নিউরাল নেটওয়ার্ক এবং মাইন্ড আপলোডিং প্রযুক্তি এই ধারণার উপরই কাজ করে।
যাই হোক, মস্তিষ্কে তৈরি হওয়া ইলেকট্রিক সিগন্যাল বিজ্ঞানীরা রীড করতে সক্ষম, অর্থাৎ বিভিন্ন কাজ করার সময় আমাদের ব্রেইনের মধ্যে যে বিভিন্ন প্রকারের সিগন্যাল তৈরি হয়, বিজ্ঞানীরা সেই সিগন্যালকে ধরতে পারে এবং কোনটি কোন কাজের জন্য উৎপাদিত হয় সেটা বুঝতে পারে। যেমন ধরুন আপনি চোখের সামনে লাল বা সবুজ রঙ দেখছেন, এখন আপনার চোখ থেকে অপটিক স্নায়ু এক ধরনের ইলেকট্রিক সিগন্যাল ব্রেইনের কাছে পাঠিয়ে দেবে।
আর ঐ সিগন্যালের মধ্যে তথ্য জিপ করা থাকে, আপনার চোখ ঠিক কোন রঙটি দেখেছে। এখন আপনি যদি ঐ সিগন্যালটি রীড করতে পারেন এবং একই সিগন্যাল ক্যামেরা থেকে নিয়ে সরাসরি মস্তিষ্কে সেন্ড করতে পারেন, তবে আপনার মস্তিষ্ক একই রঙ দেখতে পাবে, এভাবে ক্যামেরার সাহায্যে সিগন্যাল তৈরি করে অন্ধ মানুষকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব। কেনোনা অন্ধদের চোখ যতোই নষ্ট হয়ে যাক না কেন, তাদের মস্তিষ্কের সিগন্যাল চেনার ক্ষমতা কিন্তু নষ্ট হয় না।
বর্তমানে, ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস অনেকটা অগ্রগামী হলেও কম্পিউটারের মাধ্যমে মস্তিষ্ক থেকে সিগন্যাল গ্রহণ এবং মস্তিষ্কে সিগন্যাল প্রেরণের প্রক্রিয়াটি বিজ্ঞানীদের বেশ ঝামেলায় ফেলে দিয়েছে। সাধারণত, মস্তিষ্কের বহিরাবরণ বা করোটিতে ‘ইলেক্ট্রোএনসেফ্যালোগ্রাফ’ নামক অনেকগুলো ইলেক্ট্রোড স্থাপন করার মাধ্যমে নিউরন থেকে সিগন্যাল রিড করা যায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, নিউরন প্রত্যেক মুহূর্তে লক্ষ লক্ষ সিগন্যাল তৈরি করে, যার অধিকাংশই মাথার শক্ত খুলির কারণে আটকে যায়; অর্থাৎ, ইলেক্ট্রোএনসেফ্যালোগ্রাফে অধিকাংশ সিগন্যালই পৌঁছতে পারে না। পৌঁছলেও, সিগন্যালগুলো অসম্পূর্ণ ও বেশ দুর্বল অবস্থায় থাকে।
সরাসরি করোটির অভ্যন্তরীণ অংশে; অর্থাৎ, মস্তিষ্কের ঠিক উপরের অংশে ইলেক্ট্রোএনসেফ্যালোগ্রাফ স্থাপন করে এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। এতে করে মস্তিষ্কের যে জায়গাগুলো থেকে সিগন্যাল তৈরী হয়, সেসব জায়গা ও ইলেক্ট্রোড ডিভাইসগুলোর মাঝে আহামরি কোনো শক্ত বাধা না থাকায় ডিভাইসগুলোর জন্য সিগন্যাল রিড করা সহজ হয়ে যায়। কিন্তু এ প্রক্রিয়াটি বেশ বিপজ্জনক। প্রথমত, এর জন্য বেশ বড় রকমের সার্জারির প্রয়োজন হয়, যা বেশ ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ। দ্বিতীয়ত, সফলভাবে সার্জারি শেষ হলেও ধীরে ধীরে করোটির অভ্যন্তরীণ টিস্যুগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ইলেক্ট্রোড ডিভাইসগুলো যেখানেই স্থাপন করা হোক না কেন, মস্তিষ্কে কাজ চলার সময় তৈরী হওয়া সিগন্যালগুলো একই পদ্ধতিতে কম্পিউটারে ধরা পড়ে। প্রাথমিকভাবে, সিগন্যালগুলো বেশ দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে বিধায় সিগন্যালগুলোকে অ্যামপ্লিফাই ও ফিল্টার করে একটি কম্পিউটার প্রোগ্রামে রাখা হয়। প্রোগ্রামটি অনেকটা আদ্যিকালে ব্রেইন সিগন্যাল রেকর্ড করার কাজে ব্যবহৃত অ্যানসেফালোগ্রাফের ডিজিটাল সংস্করণ; রেডিও ওয়েভের মতো দেখতে সিগন্যালগুলো এখানে কাগজে ছাপার বদলে কম্পিউটারে জমা হয়। এরপর, কোন কাজের জন্য কী ধরনের সিগন্যাল তৈরী হচ্ছে, তা রিড করে একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ন অনুসরণ করে সহজেই বিসিআই সফটওয়্যারের মাধ্যমে সেসব সিগন্যালকে রিভার্স করে আবার মস্তিষ্কের নিউরনে স্থাপন করা যায়।
ধরুন, আপনি কোনো একটি দৃশ্য দেখছেন। সাথে সাথেই নিউরন দৃশ্য দেখা সম্পর্কিত কাজটির জন্য পর্যাপ্ত সিগন্যাল তৈরি করে। সিগন্যালগুলোকে ইলেক্ট্রোডগুলো রিড করে একটি কম্পিউটার প্রোগ্রামে জমা করে রাখবে। এখন চাইলেই বিসিআই প্রোগ্রামটির মাধ্যমে রিড করা সিগন্যালগুলোর নির্দিষ্ট প্যাটার্ন বুঝে ভিডিও ক্যামেরা দিয়ে ধারণকৃত কোনো দৃশ্যকে রিভার্স সিগন্যালের মাধ্যমে মস্তিষ্কের নিউরনে স্থাপন করা সম্ভব। এক্ষেত্রেও, নিউরন ভিডিও ক্যামেরায় ধারণকৃত দৃশ্যটি অবলোকন করতে পারবে।
সাধারণত, ইলেক্ট্রোডগুলো মস্তিষ্কের কোনো কোনো জায়গায় স্থাপন করে নির্দিষ্ট কাজের জন্য তৈরী সিগন্যাল রিড করা যাবে, সে ব্যাপারে ধারণা নিতে বিজ্ঞানীরা ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং বা এমআরআই স্ক্যানারের সাহায্য নেন। এমআরআইয়ে ব্যবহৃত প্রোগ্রাম বা অ্যালগরিদমটি মস্তিষ্কের বিভিন্ন জায়গার কার্যকারিতা সম্পর্কে শক্তিশালী ধারণা দিতে পারে।
ব্যাপারটি অনেকটা এরকম; ধরুন, একজন মানুষের মাথায় রোবোটিক হাত নিয়ন্ত্রণের জন্য ইলেক্ট্রোড স্থাপন করা হবে। তার জন্য, প্রথমে বিজ্ঞানীরা ঐ মানুষকে একটি এমআরআই মেশিনে প্রবেশ করিয়ে বলবেন চিন্তার মাধ্যমে হাত নাড়ানোর জন্য। এ সময়, এমআরআই দেখাবে মস্তিষ্কের ঠিক কোন জায়গাটি হাত নাড়ানোর সময় কাজ করেছে এবং এর উপর ভিত্তি করেই ইলেক্ট্রোড স্থাপন করা হবে।
তথ্যসূত্রঃ wirebd, Roadmedia, computer.howstuffworks
আরও পড়ুনঃ স্থান ও সময়ের শুরু যেখানে!