মেয়েদের ঋতুস্রাব বা পিরিয়ড বা মাসিক নিয়ে প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যে একটা আগ্রহ থাকে। বিশেষ করে মেয়েদের মনে পিরিয়ড বা মাসিক সম্পর্কে বহু প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। আজকের পোস্টে আমরা- পিরিয়ড বা ঋতুস্রাব বা মাসিক কী, মেয়েদের মাসিক কেন হয় – কীভাবে হয়, মাসিক কত দিন পর্যন্ত হয়, মাসিকের সময় করণীয়; যেমন: এ সময় কী ব্যবহার করতে হয়, কীভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হয়, কী কী খাবার খেতে হয়, এসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। চলুন তাহলে শুরু করা যাক।
ঋতুস্রাব / পিরিয়ড / মাসিক কী:
ঋতুস্রাব বা মাসিক বা পিরিয়ড সাধারণত এমন একটি শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া যে প্রক্রিয়ায় উচ্চতর প্রাইমেট বর্গের স্তন্যপায়ী প্রাণীরা [স্ত্রী লিঙ্গের] প্রজননের জন্য উপযুক্ত হয়। ঋতুস্রাব বা মাসিক প্রতি মাসে একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর হয়। যার কারণে একে ইংরেজিতে পিরিয়ড কিংবা বাংলাতে মাসিক বলে অভিহিত করা হয়।
এক কথায় মাসিকের পুরো প্রক্রিয়াটাকে বলতে গেলে, সেক্ষেত্রে এরকম বলা যেতে পারে- নারীর জরায়ু যে পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায় এবং প্রতিমাসে হরমোনের প্রভাবে মেয়েদের যোনিপথ দিয়ে যে রক্ত ও জরায়ু থেকে নিঃসৃত তরল পদার্থ বের হয়ে আসে, তাকে মাসিক বা ঋতুস্রাব বা পিরিয়ড বলে৷ যদি নারীর টিউবে ডিম্বাণু অবস্থান করার সময় অবমুক্ত ডিম্বটি পুরুষের স্খলিত শুক্র দ্বারা নিষিক্ত হয়ে এন্ডোমেট্রিয়ামে প্রোথিত (ইম্প্ল্যান্টেশন) হয়, তখন আর মাসিক বা ঋতুস্রাব হয় না! তাই মাসিক রজঃস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া নারীর গর্ভধারণের প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
⏩ Check This: ম্যানেজমেন্ট সিক্রেটস PDF Download!
মাসিক / ঋতুস্রাব / পিরিয়ড কেন হয় – কীভাবে হয়:
একজন নারী একটা বয়সে গিয়ে বড়ো হতে থাকে। যখন সে প্রজননের জন্য উপযুক্ত হতে শুরু করে ঋতুস্রাব / মাসিক / পিরিয়ড শুরু হয়; প্রজননের উদ্দেশ্যে। নারীর প্রজননের বয়সে তার শরীরে বিশেষ পরিবর্তন হয়। প্রথমেই নারীর ডিম্বাশয়ে ডিম্বস্ফোটন হয়। এরপর সেই ডিম্ব ফ্যালোপিয়ান টিউব দিয়ে জরায়ুতে চলে আসে। যেখানে ডিম্বাণুটি ৩-৪ দিন অবস্থান করে। এই অবস্থানের সময় যদি নারী পুরুষের সাথে যৌনমিলন না করে এবং তার টিউবে পুরুষের শুক্রাণু না আসে; তাহলে ডিম্বাণুটি নিষিক্ত হতে পারে না। ফলে সেটি নষ্ট হয়ে যায় এবং জরায়ুগাত্রের অভ্যন্তরে এন্ডোমেট্রিয়াম স্তরে ভেঙ্গে পড়ে। এই নষ্ট ডিম্বাণু- ভগ্ন ঝিল্লি, সঙ্গের শ্লেষ্মা এবং এর রক্তবাহ থেকে উৎপাদিত রক্তপাত সব মিশে তৈরি করে তরল অবস্থা। এরপর তার সঙ্গে ডিম্বাণুর তঞ্চিত এবং অর্ধ-তঞ্চিত মিশে ৩-৭ দিন লাগাতার যোনিপথ থেকে ক্ষরণ হতে থাকে। এই ক্ষরণকে সাধারণত ঋতুস্রাব বা মাসিক বা পিরিয়ড বলা হয়। কখনো একে গর্ভস্রাব, রজঃস্রাব বলেও অভিহিত করা হয়।
মাসিক / ঋতুস্রাব / পিরিয়ড কখন থেকে শুরু হয়:
একটা মেয়ে ১০-১২ বছর বয়সে পৌঁছালে, অর্থাৎ কৈশোর থেকে বয়ঃসন্ধিকালে পদার্পণ করলে; তার কিছু শারীরিক পরির্বতন হয়। যেমন:
- উচ্চতা বাড়ে
- স্তন বড়ো হয়
- বগলে ও যৌনাঙ্গে লোম গজায়
- কোমর সরু হয়
- উরু ও নিতম্ব ভারি হয়
- জরায়ু ও ডিম্বাশয় বড়ো হয় এবং সন্তান জন্মদানের উপযোগী হয়ে ওঠে; এবং
- মাসিক শুরু হয়!
এসব পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই একজন মেয়ের বড়ো হয়ে ওঠা। বয়ঃসন্ধিকালে কোনো মেয়ের মাসিক শুরু হওয়া জানান দেয় যে- তার ডিম্বাশয় পরিপক্ব ডিম্বাণু উৎপাদনে প্রস্তুত এবং তার জরায়ু গর্ভধারণের জন্য উপযুক্ত। মাসিকের মাধ্যমেই একজন নারী মা হওয়ার সক্ষমতা অর্জন করে!
পিরিয়ড / ঋতুস্রাব / মাসিক কত দিন হয় এবং মাসিক চক্র কত বছর পর্যন্ত চলতে থাকে:
ঋতুস্রাব / মাসিক / পিরিয়ড একজন মেয়ের শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। মেয়েদের সাধারণত ৯-১৩ বছর বয়সে মাসিক শুরু হয় এবং ৪৫-৫৫ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতিমাসে চলতে থাকে। ঋতুস্রাব বা মাসিক শুরু হওয়ার জন্য শারীরিক গ্রোথ এবং পরিবেশ অনেকাংশে দায়ী। অনেক সময় ৯ বছর বয়সেই একজন মেয়ে প্রজননে সক্ষম হয়। মাসিক শুরু হওয়ার পর মেয়েরা চাইলেই গর্ভ ধারণ করতে পারে। তবে শরীর পুরোপুরি গঠন হতে ২০ বছর অবধি সময় লাগে। তাই এর আগে গর্ভধারণ করলে মা ও সন্তান উভয়ের স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে। মাসিক বা ঋতুস্রাব প্রতি ২৮ দিন পর পর চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। কারও কারও ক্ষেত্রে আগে পিছে হতে পারে। আর প্রতিমাসে ক্ষরণ হতে স্বাভাবিক সময় নেয় ৩-৭ দিন। এক্ষেত্রে দুই-একদিন কমবেশি হতে পারে! এর বেশি সময় স্থায়ী হলে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে আলোচনা করা উচিত।
প্রতিবার মাসিক / ঋতুস্রাব / পিরিয়ড শুরু হওয়ার লক্ষণ:
ঋতুস্রাব / মাসিক / পিরিয়ড হওয়ার আগে বেশ কিছু লক্ষণ দেখা যায়। মাসিক হলে মেয়েদের বিভিন্ন শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। যেমন:
- মাথা ব্যথা
- মাথা ঝিমঝিম করা
- খিদে না পাওয়া
- বমি বমি ভাব
- স্তন ফুলে যাওয়া
- অল্পতেই অবসাদ অনুভব করা
- ঘুমের সমস্যা
- কোনো কোনো মহিলার ক্ষেত্রে মেজাজের পরিবর্তন হওয়া ও খিটখিটে হয়ে যাওয়া
মাসিক / ঋতুস্রাব / পিরিয়ডের সময় করণীয়:
ঋতুস্রাব বা মাসিক হলে খাবারে বিশেষ নজর রাখা উচিত। কেন না মাসিক পুরো মানবজাতির টিকে থাকার একটা অংশ কিন্তু। তাই বাড়তি একটু যত্ন এইসময় অবশ্যই নিতে হয়। ফলে মেয়েরা বিভিন্ন রোগ এবং সমস্যা থেকে মুক্ত থাকতে পারবে। পিরিয়ড বা মাসিকের সময় সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে। মাসিক বা পিরিয়ডের সময়কালীন সঠিক খাদ্যতালিকা দেখে নেওয়া যাক!
ঋতুস্রাব / মাসিক হলে কি কি খাবার খেতে হয়:
- শর্করা জাতীয় খাবার: ডাল, সবুজ শাকসবজি, দই, আলু, ইত্যাদি।
- আমিষ জাতীয় খাবার: দুধ, ডিম, বাদাম, মাছ, মাংস, কলিজা, ইত্যাদি।
- আয়রন বা লৌহ জাতীয় খাবার: ডিম, সিম, পালংশাক, আলু, কলা, আপেল, গুড়, খেজুর, কালোজাম, ইত্যাদি।
- ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার: বাদাম, সয়াবিন, গাঢ় সবুজ শাকসবজি।
- ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার: দুগ্ধজাত খাবার, দুধ, ডিম, বাদাম, এবং সয়াবিন।
- এ ছাড়া খেতে হবে কম লবণযুক্ত খাবার।
- তাজা ফলের রস (বিশেষ করে ডালিম)।
- প্রচুর পানি পান করতে হবে। কেন না মেয়েদের শরীরে তখন পানির ঘাটতি দেখা যায়।
- এই সময় চা-কফি পান করা থেকে বিরত থাকা উচিত।
পিরিয়ড সম্পর্কে ইউটিউবের এই এক্সপ্লেইনেশন ভিডিয়োটা দেখতে পারেন:
Read More: Top 5 Best Wi-Fi Routers Under 50 Dollars In 2021!
ঋতুস্রাব / পিরিয়ডের সময় কী ব্যবহার করতে হবে এবং কীভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে:
মাসিক বা ঋতুস্রাবের সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা খুবই জরুরি। এই সময় পরিষ্কার অন্তর্বাস, পরিষ্কার মাসিকের কাপড় বা প্যাড ব্যবহার করতে হবে। মাসিকের কাপড় প্রতি এক থেকে দুইমাস পর পর পরিবর্তন করতে হবে। নিয়মিত গোসল করতে হবে।
মাসিকের কাপড় (প্যান্টি) ধোয়ার সময় সাবান বা ডিটারজেন্ট ব্যবহার করতে হবে এবং পানি স্বাভিবিক তাপমাত্রার রাখতে হবে। খোলামেলা জায়গা যেখানে বাতাস এবং রোদ রয়েছে এমন জায়গায় কাপড় শুকাতে দিতে হবে। স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় কাপড় শুকাতে দেওয়া যাবে না। যেমন খাটের নিচে কিংবা আসবাবপত্রের পেছনে। এতে করে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্যাড বা কাপড় পরিবর্তনের আগে ও পরে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিতে হবে। যৌনাঙ্গে এই সময় সাবান ব্যবহার করা উচিত নয়। হাল্কা কুসুম গরম পানি দিয়ে যৌনাঙ্গ ধুয়ে নেওয়া উচিত। কারণ যোনির নিজস্ব নিষ্কাশন পদ্ধতি আছে। সাবান ব্যবহার করলে ইনফেকশন হবার সম্ভাবনা রয়েছে। পিরিয়ড / মাসিকের সময় অবশ্যই যৌনাঙ্গ শুকনো রাখা উচিত। ভেজা থাকলে নানান জীবাণু সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে।
ঋতুস্রাবে ব্যবহার করা প্যাড বা কাপড় কাগজ দিয়ে ভালোভাবে মুড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলতে হবে। এই সময় প্রতি ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা পরপর পরিবর্তন করা উচিত। নতুবা ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ হবার সম্ভাবনা থাকে। রক্ত ক্ষরণ বেশি হলে সেক্ষেত্রে আরও কম সময়ের মধ্যেও প্যাড বা কাপড় পরিবর্তন করা উচিত।
মাসিকের সময় একটা প্রচলিত সমস্যা তলপেটে ব্যথা। এই ব্যথা কিছু নিয়ম মেনে চললে কিছুটা নিরাময় করা যায়। যেমন- তলপেটে ব্যথা অনুভব হলে, ওয়াটার ব্যাগে গরম পানি নিয়ে ছ্যাঁক দেওয়া। কুঁজো বা উপুর হয়ে ঘুমানো উচিত নয়। বেশি হাঁটা কিংবা দৌড়াদৌড়ি করা উচিত নয়। কেন না এই সময় গর্ভাশয় খুবই সেনসিটিভ থাকে।
ঋতুস্রাব বা মাসিক বা পিরিয়ড স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও এটি কোনো ফেলনা বিষয় নয়। তাই নিজে সচেতন হন, সুস্থ থাকুন। আপনার প্রিয় মানুষটির যত্ন নিন। কেন না একটু অবহেলা হতে পারে মৃত্যুর কারণ।
লেখা: ইসরাত জাহান জান্নাত
আরও পড়ুন: প্রেগন্যান্ট না হলেও প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট আসতে পারে পজেটিভ!