Home » নিজেকে মৃত ভাবা রোগঃ কটার্ড সিনড্রোম
কটার্ড সিনড্রোম

নিজেকে মৃত ভাবা রোগঃ কটার্ড সিনড্রোম

একজন মধ্য বয়সী নারী কটার্ড এর নিয়মিত রোগী ছিলেন। তিনি প্রায় আজগুবি সব সমস্যা নিয়ে কটার্ড এর কছে আসতেন। সেই রোগীর নাম ছিল মাদামোয়াজেল এক্স। কখনো কখনো মাদামোয়াজেল বলতেন, তার এমনটা মনে হচ্ছে যে তার কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। অাবার কখনো কখনো জানাতেন, তিনি তার ইন্দ্রিয়গুলোকে অনুভব করতে পারছেন না।

মাদামোয়াজেলের মনে হতো, তার পেটের মধ্যে কোনো নাড়িভুড়ি নেই, তাই ক্ষুধা লাগলে খাবার খেতে হবে, এই প্রয়োজন তিনি অনুভব করতেন না। এই লাগামহীন জীবন-যাপনের কারণে কটার্ডের এই রহস্যময় রোগী একসময় মারা যান।

কটার্ড এই অদ্ভুত মেডিক্যাল কন্ডিশনকে অভিহিত করেন, ‘delire des negations’ নামে। তবে রোগটিকে কটার্ড সিনড্রোম নামে সর্বপ্রথম অভিহিত করেন সেগলাস, ১৮৮৭ সালের দিকে। এর কিছু বছর পরে রেজিস রোগটিকে ‘delire de cotard হিসেবে অভিহিত করেন এবং দেখান যে, রোগটির সাথে বিষণ্নতা ছাড়াও অন্যান্য মনস্তাত্ত্বিক বৈকল্যের সম্পর্ক রয়েছে।

কটার্ড সিনড্রোম

কটার্ড সিনড্রোম এমন একটি অসুস্থতা বা মেডিক্যাল কন্ডিশন, যাতে আক্রান্ত হলে রোগী মনে করতে শুরু করেন, তিনি অসলে মারা গেছেন। মাঝে মাঝে রোগী এও ভাবতে শুরু করেন যে তার শরীরের কোনো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের অস্তিত্ব তিনি অনুভব করতে পারছেন না। অনেকসময় তিনি নিজেকে অমর হিসেবেও দাবি করতে পারেন। অনেকসময় রোগীর চালচলনে নিজেকে মৃত জাহির করার প্রবণতাটা এতই প্রকট হয়ে ওঠে যে, রোগীকে দেখে আপাতদৃষ্টিতে জ্যান্ত লাশ বলে মনে হয়। তাই এ রোগকে অনেকে ‘দ্য ওয়াকিং কর্পস সিনড্রোম’ বলেও অভিহিত করে থাকেন।

২০০৮ সালের ঘটনা এটি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক নারীকে ভর্তি করা হলো নিকটস্থ হাসপাতালে। যিনি ভর্তি হলেন, তিনি একজন ফিলিপাইনি গৃহিনী, বয়স তেপ্পান্ন ছাড়িয়েছে। রোগীর স্বজনেরা জানালেন, রোগী নানা অসংলগ্ন আচরণ করে তাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছেন। যার মধ্যে সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপারটি হলো, রোগী বারবার নিজেকে মৃত দাবি করে মর্গে যাবার জন্য উতলা হয়ে উঠেছেন এবং বারবার ৯১১ এ ফোন করবার জন্য চেঁচামেচি করছেন।

যখন হাসপাতালে রোগীর সাক্ষাৎকার নেয়া হলো, তখন তিনি অাতঙ্কিত কণ্ঠে বললেন, তার নিজের কাছে নিজেকে মৃত বলে মনে হচ্ছে। তাই তিনি চাইছেন, তাড়াতাড়ি সমাধিস্থ হতে, যাতে এই জ্যান্ত লাশ হয়ে ঘুরে ফিরবার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে পারেন।

রোগী অারো জানালেন, ফিলিপাইনে থাকার সময় থেকেই তিনি তীব্র বিষণ্নতায় ভুগতে শুরু করেন, যার জন্যে অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্টও সেবন করছেন। তবে সেগুলো কোন ব্র্যান্ডের এবং সেগুলোর ডোজই বা কতটুকু, তা সম্পর্কে কিছুই বলতে পারলেন না।

চিকিৎসকেরা অারো একটি ব্যাপার লক্ষ করলেন- রোগী দীর্ঘদিন ধরে ঠিকভাবে খাওয়া-দাওয়া না করার কারণে শীর্ণকায় হয়ে পড়েছেন। দীর্ঘদিন একই পোশাক পরে থাকবার ফলে সেটি জীর্ণদশা ধারণ করেছে। রোগীর ভাষ্যমতে, “মৃত মানুষের খাবার কিংবা পোশাকের প্রয়োজন হয় না”

রোগীর এই অসংলগ্ন কথাবার্তা এবং আচরণ চিকিৎসকদের একটি দিকেই ইঙ্গিত করলো। রোগী এক অদ্ভুত মেডিক্যাল কন্ডিশনে ভুগছেন। এই অদ্ভুত মেডিক্যাল কন্ডিশনের নাম কটার্ড সিনড্রোম।

কীভাবে বোঝা যাবে?

কটার্ড সিনড্রোমের প্রথম এবং প্রধান উপসর্গ হলো নিহিলিস্টিক মনোভাব। এই মনোভাবের মূল কথা হলো, জীবনের কোনো মানে নেই, কোনো কিছুরই কোনো মানে নেই। যারা কটার্ড সিনড্রোমে ভোগেন, তারা মনে করেন এই পুরো পৃথিবীটাই একটা ভ্রম বা কল্পনা, এর কোনো বাস্তব অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।

কটার্ড সিনড্রোমের রোগীদের মধ্যে বেশিরভাগই আক্রান্ত হন আকণ্ঠ বিষণ্নতায়। ২০১১ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, কর্টাড সিনড্রোমে আক্রান্ত রোগীদের ৮৯ শতাংশই বিষণ্নতাকে তাদের অন্যতম উপসর্গ বলে স্বীকার করেন। প্রাপ্ত একশোটির মতো কেস স্টাডি পর্যালোচনা করে প্রাপ্ত এ ফলাফলে অন্যান্য প্রধান উপসর্গগুলো হলো, নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব (৬৯ শতাংশ), উদ্বেগ (৬৫ শতাংশ), অপরাধবোধজনিত বিভ্রান্তি (৬৩ শতাংশ), নিজেকে অমর মনে করা (৫৫ শতাংশ) এবং হাইপোকন্ড্রিয়াক ডিলিউশন (৫৮ শতাংশ)।

বিষণ্নতার কারণে এই সিনড্রোমের রোগীদের মধ্যে গড়ে ওঠে এক ‘কোথাও কেউ নেই’ ধরনের মনোভাব। যার কারণে তারা নিজেদের জীবন এবং অস্তিত্বকে তুচ্ছ এবং অর্থহীন মনে করতে শুরু করেন।

নিজেকে তুচ্ছ ও অস্তিত্বহীন ভাববার প্রবণতা প্রভাব ফেলে তাদের জীবনযাপনেও। অনেকেই হারিয়ে ফেলেন জীবনের লক্ষ্য। উদ্দেশ্যহীন ও ভবঘুরে জীবনযাপনই তাদের দৈনন্দিন রুটিন হয়ে দাড়ায়।

এ রোগের রোগীরা গোসল না করেই কাটিয়ে দেন দিনের পর দিন। অনেকে নখ-চুল কাটা বন্ধ করে দেন। কারণ তাদের কাছে নিজ নিজ দেহ তো ‘মৃত’! অনেকে তো অারো এক কাঠি সরেস! প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেবার পর শৌচকর্মটি পালন করতে অনীহা দেখা যায় তাদের মধ্যে।

অনেক রোগীর কাছে মনে হয়, তারা তাদের হাত-পা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর অস্তিত্ব অনুভব করতে পারছেন না। যদিও সাধারণ মেডিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যেগুলো বিকল বা অবশ হয়ে যাবার কোনো লক্ষণই দেখা যায় না।

তথ্যঃ roar media

আরও পড়ুনঃ অটিজম যাদের জন্য আশীর্বাদ ছিল!

পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন: