আমরা সব সময় চাই, নতুন কোন জায়গায় ঘুরতে যেতে । আপনি কোন একটা জায়গায় ঘুরতে গেছেন। পরিবেশটা খুবই সুন্দর। হঠাৎ আপনার মনে হতে লাগলো জায়গাটা পরিচিত। এর আগেও ঠিক একই জায়গা কোথায় যেন আপনি দেখেছেন। স্বপ্নে অথবা বাস্তবে এই জায়গাটাই আপনি এসেছেন। হয়তো খুব ছোটবেলায় এই জন্যে অল্প অল্প মনে মনে আছে। এই ব্যাপারটাকেই বলা হয় দেজা ভু
প্রায় প্রত্যেকটা মানুষ জীবনে একবার হলেও এই ঘটনার সম্মুখীন হন । কারো কারো ক্ষেত্রে বহুবার ঘটে । যাদের দেজা ভুর অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের কাছে ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত মনে হয় এবং এই ঘটনার খুব তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী একটি প্রভাব থেকে যায়। আর যাদের জীবনে দেজা ভূঁ ঘটেনি তাদের কাছে ব্যাপারটা প্রায় অসম্ভব ও অকল্পনীয় মনে হয়। দেজা ভূ মনোবিজ্ঞানে খুবই জনপ্রিয় এবং রহস্যময় একটি ঘটনা।
দেজা ভু বলতে বোঝায় একটা তীব্র অনুভূতি যেন পূর্বে ঘটে যাওয়া কোন অভিজ্ঞতার সাথে বর্তমান ঘটনার সাদৃশ্য আছেে কিন্তু দুটো ঘটনা পুরোপুরি এক নয়। অথবা ভবিষ্যৎ জেনে যাবার মতো অনুভূতি যেন আপনি জানেন যে পরবর্তীতে কী ঘটবে। এই অনুভূতি কয়েক মিনিটের মতো স্থায়ী হতে পারে, তবে সাধারণত কয়েক সেকেন্ড থাকে।
দেজা ভুর সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত সজ্ঞাটি হচ্ছে, “অজানা কোন অতীতের সাথে বর্তমানের কোন অভিজ্ঞতার ব্যাখাতীত সাদৃশ্য খুজে পাওয়ার অনুভূতি। ” চার্লস ডিকেন্সের বিখ্যাত উপন্যাস ডেভিড কপারফিল্ডের একটি লাইনে দেজা ভুর চিত্র ফুটে উঠেছে ঝকঝকেভাবে।
“কখনো কখনো আমাদের এরকম অভিজ্ঞতা হয়, আমরা অনুভব করি যেন আমরা যা বলছি বা করছি তা আগেওও বলেছি বা করেছি, সুদূর অতীতের কোন এক সময়ে। যেন কোন এক অস্পষ্ট অতীতে আমরা বর্তমানে দেখা একই চেহারা,একই বস্তু দেখেছি বা বর্তমানের মতো একই পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে গিয়েছিলাম। আমরা যেন একদম ঠিকঠিক জানি একটু পর কী বলা হবে,যেন হঠাৎই আমাদের তা মনে পড়ে যায়। “
দেজাভূ-র উল্টো পিঠঃ
জামিয়াস ভূ দেজা ভুর ঠিক বিপরীত ঘটনা। দেজা ভুতে অনুভুত হয় সাদৃশ্যের অনুভূতি কিন্তু জামিয়াস ভূতে অনুভূত হয় বৈসাদৃশ্যের অনুভূতি। জামিয়াস ভু অর্থ হচ্ছে “never seen” অর্থাৎ আপনি কখনোই দৃশ্যটি দেখেননি। জামিয়াস ভু হচ্ছে এরকম যেন আপনার বর্তমান পরিস্থিতি কোথাও দেখেছেন কিন্ত তা আপনার অপরিচিত লাগছে। ধরুন,আপনি আপনার শোবার ঘরে হাটছেন, তখন মনে হত পারে যেন আপনি কখনো সেখানে আসেনইনি। কিন্তু আপনি নিশ্চিত জানেন যে এটা আপনারই শোবার ঘর। জামিয়াস ভু দেজা ভুর তুলনায় খুবই অল্প ঘটে। মানসিক চাপ,ক্লান্তি প্রভৃতির কারণে জামিয়াস ভুর অভিজ্ঞতা হতে পারে।
দেজা ভু একটি সাধারণ ঘটনা তবে সার্বজনীন ঘটনা নয়। পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ জীবনে অন্তত একবার এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়। এটি তরুণদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে দেজা ভুর পৌনপৌনিকতা কমে আসে। ভ্রমণ,ক্লান্তি,মানসিক চাপ প্রভৃতির প্রভাবেও দেজা ঘটে থাকে। যদিও এখন পর্যন্ত দেয়া কোন তত্ত্বই দেজা ভুকে পুরোপুরি ব্যাখা করতে পারে না, তবে কগনিটিভ সায়েন্সের ভবিষ্যত গবেষণা এ নিয়ে আমাদের আরো নতুন তথ্য জানাতে পারে বলে আশা করা যায়।
দেজা ভুকে ব্যাখা করার জন্য অসংখ্য তত্ত্ব প্রস্তাব করা হয়েছে যা জন্মান্তরবাদ, ঐশ্বরিক বার্তা থেকে শুরু করে মস্তিষ্কে কোন সংকেতের বিলম্বিত প্রবাহ পর্যন্ত বিস্তৃত। দেজাভূঁ নিয়ে অসংখ্য তত্ত্ব প্রচলিত থাকলেও মোটামুটি চারটি প্রধান তত্ত্ব দ্বারা দেজা ভুকে ব্যাখা করা যায়। এগুলো হল- Dual Processing Theory, Neurological Theory, Memory Theory, Attentional Theory.
ডুয়েল প্রসেসিং থিওরি:
এই থিওরি অনুযায়ী দুইটা নিরীহ চিন্তা একইসাথে চলতে চলতে হঠাত কিছুক্ষণের জন্য আলাদা হয়ে গেলে দেজাভূঁ ঘটে। এইরকম আলাদা হওয়ার ঘটনা ঘটে যখন দুইটা চিন্তার একটা ভুল সময়ে আবির্ভূত হয়। যেমন-সাদৃশ্য এবংস্মৃতি থেকে সেই সাদৃশ্য কোথা থেকে এল তার পুনরুদ্ধার সাধারণত একইসাথে ঘটে। কিন্তু যদি সাদৃশ্যের চিন্তা স্মৃতি পুনরুদ্ধারের অনুপস্থিতিতে চলে আসে তাহলে দেজাভূঁ ঘটবে। আবার এর বিপরীত চিন্তাপ্রবাহও দেজাভূঁ ঘটায়। মানে দুইটা চিন্তা আলাদাভাবে চলতে চলতে হঠাত একসাথে হয়ে গেলে (তরঙ্গের উপরিপাতনের মত) তখন দেজাভূঁ ঘটে।
নিউরোলজিক্যাল থিওরি:
এই থিওরি বলে যে মস্তিষ্কে প্রবাহিত সংকেতের গতিতে পরিবর্তনের ফলে দেজা ভু ঘটে। সংকেত প্রবাহের গতির এই পরিবর্তন ঘটে দুইভাবে- একক পথে,দ্বৈত পথে। একক পথে সংকেত প্রবাহের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কে সংশ্লিষ্ট সংকেত একটু ধীরে যায়। তারপর যখন পৌছায় মগজে তখন স্বাভাবিকের তুলনায় ধীরে যাওয়ায় দেজাভূঁ ঘটে। দ্বৈত সংকেত প্রবাহের ক্ষেত্রে মূখ্য সংকেতটি ধীরে যায়। তখন ধীরগতির মূখ্য ওস্বাভাবিক গৌণ সংকেত প্রবাহের তুলনার ফলে ভবিষ্যত জানার অনুভূতি অনুভুত হয়।
মেমোরি থিওরি:
মেমোরি থিওরিতে বস্তুগত সাদৃশ্যকে আলোকপাত করা হয়েছে। এ থিওরি অনুযায়ী,একটা দৃশ্যের কোন বস্তু বা পুরো দৃশ্যটাই অন্য দৃশৃযের সাথে মিল আছে মনে হতে পারে। একটি বা বহু বস্তুর সাদৃশ্যের থিওরি বলে যে,একই বস্তু বিভিন্ন দৃশ্যে দেখা কখনো কখনো সাদৃশ্যের একটা অনুভূতি নিয়ে আসে। এভাবে দেজা ভু ঘটে।
এটেনশনাল থিওরি:
এই থিওরিতে ধারণা করা হয় যে,একই উদ্দীপনা সম্পর্কে দ্রুত দুইটি অনুভূতি অনুভব করার জন্য দেজাভূঁ ঘটে। হতে পারে আপনি কোনকিছু পূর্ণ সচেতনতার সাথে চিন্তা করছেন,কিছুক্ষণের জন্য আপনার চিত্তবিক্ষেপ ঘটল, আপনার মনোযোগে খুব সামান্য বিরতি বা প্রাথমিক উপলব্ধি কোনভাবে ক্ষীণ হয়ে যাওয়া এক ধরনের সাদৃশ্যের অনুভূতি নিয়ে আসতে পারে।