সাধারণত রোগ আমাদের কাছে পরিচিত হয় তা কতজন মানুষের হয় তার উপর ভিত্তি করে। যেমন জ্বর এর নাম আমরা সবাই জানি কারণ কমবেশি সবারই জ্বর হয়। জ্বর একটা পরিচিত রোগ। এমন অনেক রোগের নাম সবাই জানে । কিন্তু কিছু রোগ আছে যেগুলার নাম আমরা জানিনা এমনকি ডাক্তারেরাও প্রথম অবস্থায় বুঝে উঠতে পারেনা।
হিমোফিলিয়া প্রথম দেখা যায় গ্রেট ব্রিটেনের রানী ভিক্টোরিয়ার বংশধরদের মধ্যে । ব্রিটেনের রাজবংশ থেকে এই রোগ ধীরে ধীরে রাশিয়া, স্পেন ও জার্মান রাজবংশে ছড়িয়ে পড়ে। এজন্যই একে ‘রাজকীয় রোগ’ বলা হয়।
হিমোফিলিয়া কী ?
হিমোফিলিয়া এক ধরনের জন্মগত রক্তরোগ। এই রোগে রক্ত তঞ্চনে সমস্যা হয় তাই একবার রক্তনালী কেটে গেলে আর রক্তপাত বন্ধ হয় না। শুধু পুরুষলোক এই রোগে আক্রান্ত হয় এবং স্ত্রীগণ এই রোগের বাহক, কারণ স্ত্রীদের দুটি এক্স ক্রোমোজোম থাকে আর পুরুষদের একটি এক্স ও অপরটি ওয়াই ক্রোমোজোম। ফ্যাক্টর VIII এর অভাবে হিমোফিলিয়া এ (A) এবং ফ্যাক্টর IX এর অভাবে হিমোফিলিয়া বি (B) রোগ হয়।
একজন হিমোফিলিয়া আক্রান্ত রোগীর দেহে এই ক্লট সৃষ্টির প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিক নয়। ব্যাপারটি আসলে এমন নয় যে, রোগীর দেহ থেকে অঝোরে এবং খুব দ্রুত রক্তক্ষরণ হতে থাকবে। মূলত একজন হিমোফিলিয়াক (যারা হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত) ব্যক্তির দেহ থেকে দীর্ঘ সময় ধরে রক্তক্ষরণ হতে থাকে।
আরেকটি বিষয় পরিষ্কার করা দরকার। অনেকে হয়তো এখন মনে করছেন যে, এই রোগ হলে হাত, পা, হাঁটু ইত্যাদির কোথাও কেটে গেলেই তা থেকে অনবরত রক্ত ঝরতে থাকবে। ব্যাপারটি ঠিক তা নয়। দেহের বাইরের কোনো ছোটখাটো আঘাত এখানে খুব একটা চিন্তার বিষয় নয়। আসল চিন্তার বিষয় হলো ইন্টারনাল ব্লিডিং বা দেহের অভ্যন্তরীণ কোনো অংশে রক্তক্ষরণ। এই ধরণের রক্তক্ষরণকে হ্যামোরেজ বলে। এটি মূলত দেখা যায় দেহের ভিতরে কোনো সন্ধি যেমন হাঁটু ও গোড়ালিতে। এছাড়া দেহের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন টিস্যু ও পেশীর মিলনস্থলেও রক্তক্ষরণ হতে পারে। দেহের ভিতরে এমন রক্তক্ষরণ অনেক যন্ত্রণাদায়ক হয় এবং আক্রান্ত অংশ বেশ ফুলতে শুরু করে।
কেন হয় ?
হিমোফিলিয়া একটি বংশগত রোগ। জিনগত বিভাজন বা মিউটেশনের মাধ্যমে এই রোগের উৎপত্তি হয়েছে। সাধারণত হিমোফিলিয়া রোগটিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো হিমোফিলিয়া–এ, হিমোফিলিয়া–বি এবং হিমোফিলিয়া-সি। হিমোফিলিয়া–বি রোগকে ক্রিসমাস ডিজিসও বলা হয়। হিমোফিলিয়া আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে শতকরা আশি ভাগ ক্ষেত্রে হিমোফিলিয়া–এ ধরা পড়ে। পাঁচ হাজার থেকে দশ হাজার ছেলে নবজাতকের মধ্যে একজন হিমোফিলিয়া–এ রোগে আক্রান্ত হয়।
রক্তে ক্লটিং ফ্যাক্টর-৮ (Clotting Factor VIII) এর অনুপস্থিতির কারণে এই রোগ দেখা দেয়। হিমোফিলিয়া–বি হিমোফিলিয়া–এ এর তুলনায় কম দেখা যায়। প্রতি বিশ হাজার থেকে চৌত্রিশ হাজার নবজাতক ছেলে শিশুর মাঝে একজন হিমোফিলিয়া–বি রোগে আক্রান্ত হয়। রক্তে ক্লটিং ফ্যাক্টর-৯ (Clotting Factor IX) এর অনুপস্থিতির কারণে হিমোফিলিয়া–বি দেখা দেয়। হিমোফিলিয়া–সি আগের দুটি থেকেও অপেক্ষাকৃত বেশি বিরল। প্রতি এক লক্ষে একজন লোকের এই রোগ ধরা পড়ে। পুরুষ ও নারী উভয়ই হিমোফিলিয়া–সি রোগে আক্রান্ত হতে পারে। রক্তে কোয়াগুলেশন ফ্যাক্টর -৯ (Coagulation Factor XI) এর অনুপস্থিতিতে এই রোগ হয়।
হিমোফিলিয়া একটি সেক্স লিঙ্কড রিসেসিভ ডিজঅর্ডার (X-Linked Recessive Disorder)। পুরুষ ও নারীর প্রত্যেকের এক জোড়া সেক্স ক্রোমোজোম রয়েছে। নারীর এই একজোড়া সেক্স ক্রোমোজোম হলো XX এবং পুরুষের ক্ষেত্রে তা হলো XY। এগুলোর মাঝে X ক্রোমোজোমের মিউটেশনের কারণেই মূলত হিমোফিলিয়া রোগের আবির্ভাব ঘটে। যেহেতু নারীদের X ক্রোমোজোমের সংখ্যা বেশি, তাই তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই রোগের প্রধান বাহক হয়।
একজন হিমোফিলিয়ার বাহক নারীর মাধ্যমে পঞ্চাশ শতাংশ ক্ষেত্রে ছেলে সন্তান রোগ ধারণ করে এবং পঞ্চাশ শতাংশ ক্ষেত্রে মেয়ে সন্তান রোগের বাহক হয়। হিমোফিলিয়া আক্রান্ত বাবা থেকে তার মেয়ে সন্তান এই রোগের জিন অবশ্যই বহন করবে। আবার বাবা এই জিন বহন করলেও মা যদি বাহক না হয়, তবে এই রোগ ছেলে সন্তানের মাঝে দেখা দেবে না।
আরও পড়ুনঃ সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স-ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স