অটিজম শব্দটা শুনলেই একটা অসহায় কিছু চোখের সামনে ভাসে। সত্যি বলতে আসলেও এটা তাই। তবে আমি গত কিছুদিন বিভিন্ন ভিডিও দেখেছি যারা শরীরের প্রতিবন্ধকতা নিয়েও বিভিন্ন খেলায় অংশ নিচ্ছে । ব্যাডমিণ্টন, ফুটলের মতো খেলাও তারা খেলছে। অটিজমের পরিমাণ ও দিন দিন বেড়ে চলেছে এ বিষয়ে আমাদের সচেতন হওয়া জরুরি। ২০১৮ সালের জরিপ অনুয়ায়ি তি ৫৯ জন শিশুর মধ্যে একজন অটিজমে আক্রান্ত শিশুর জন্ম হয়। তবে এটা যে সব সময় অভিশাপ তা কিন্তু নয় । আজ এমন কিছু মানুষের গল্প শুনবো যারা অটিজম এ আক্রান্ত হয়েও জয় করেছেন পৃথিবী।
কিম পিক
১৯৫১ সালের ১১ই নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের উতাহর সল্ট লেক সিটিতে কিম পিক জন্মগ্রহণ করেন। দুর্ভাগ্যবশত জন্মের সময় ম্যাক্রোসেফ্যালি নামক একধরনের সমস্যায় আক্রান্ত হন কিম, যার কারণে মাথার খুলি কিংবা ক্রেনিয়াম হাড় শরীরের তুলনায় বড় হয়ে যায়। তার মগজের দুটি হেমিস্ফেয়ারকে জোড়া লাগানো স্নায়ুগুলোর বেশ কয়েকটা ছিল না। ধারণা করা হয়, মস্তিষ্কে কর্পাস ক্যালোসামের অনুপস্থিতিতে তার নিউরনগুলো স্বাভাবিক যেকোনো মানুষের তুলনায় অনেক বেশি সক্রিয় ছিল। এভাবেই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিটা অভিশাপের বদলে আশীর্বাদ হয়ে আসে কিম পিকের জন্য।
রেইনম্যান মুভির ডাস্টিন হফম্যানের চরিত্রের কথা মনে আছে? সেই চরিত্রটি ছিলো আদতে কিম পিক নামের এক মানুষের। অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার পরও মুখস্থ করার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছেন এই ব্যক্তি। যেকোনো বই এক ঘন্টা পড়ার পর তার ৯৮% অংশই মনে রাখতে পারেন কিম। তার প্রায় ১২,০০০ বই মুখস্থ রয়েছে। এর পাশাপাশি গণিতেও রয়েছে তাঁর দারুণ দক্ষতা।
অথচ জন্মের চার বছর পর্যন্ত হাঁটতেই পারেননি তিনি। নিজের শার্টের বোতামও লাগাতে শেখেননি এখনও। সাধারণ মানুষদের তুলনায় অনেক নিচে তাঁর আইকিউ লেভেল। এখনও স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। জন্মের সময় কিমের মস্তিষ্কের সেরেবাল কলোসাম ছিলো না, যেটির কাজ মগজের দুই অংশকে সংযুক্ত করা। তাই অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতো স্বাভাবিক কাজগুলোও করতে পারেন না কিম। তারপরও এসব প্রতিবন্ধকতা ঠেলে কিম পিক আজ নিজেকে দৃষ্টান্তরূপে স্থাপন করেছেন।
লেসলি লেমকে
জন্ম হয় দুর্ভাগ্য সাথে নিয়ে । জন্মের কিছুদিন পরই কোন এক কারণ বশত ডাক্তাররা তার চোখ অপারেশন করে বাদ দিয়ে দেয়। লেমের মা পর্যন্ত তাকে অগ্রাহ্য করে। একেবারে স্বাভাবিক ছিল না সে। শেষ পর্যন্ত একজন নার্স তার দেখা শোনার দায়িত্ব নেয় । তিনি হাঁটা চলা করতে পারতেন না । এইভাবে চলেছে ১২ বছর পর্যন্ত। লেসলি যখন ১৬ বছর বয়সে একদিন হঠাৎ করেই তাকে পিয়ানো বাজাতে দেখা যায়। আমৃত্যু করেছেন বিভিন্ন কনসার্ট । জয় করে নিয়েছেন দর্শকদের মন ।
স্টিফেন উইল্টশায়ার
স্টিফেন উইল্টশায়ার এর আরো একটি নাম আছে তা হলো ক্যামেরা মানব । অর্থাৎ ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুললে যেমন হুবহু আসে ঠিক তিনি যখন কোন কিছু দেখে ছবি আঁকেন তা হুবহু আসে । সে যা দেখে তা কখনই ভোলেন না । অটিজম তার কোন বাধাই হতে পারেনি ।
২০০৯ সালে হেলিকপ্টার দিয়ে মাত্র ২০ মিনিট নিউইয়র্ক সিটি ঘুরেছিলেন। ২০ মিনিটে হেলিকপ্টারটি নিউইয়র্ক সিটির ৩০৫ বর্গমাইল অতিক্রম করে। আর ২০ মিনিটের ভ্রমণে ৩০৫ বর্গমাইলে যা কিছু উইল্টশায়ার দেখেছেন, অর্থাৎ নিউ জার্সির সমুদ্রতটের হুডসন সিটি, ফিন্যানশিয়াল ডিস্ট্রিক্ট, এলিস আইল্যান্ড, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি এবং ব্রুকলিনের রাস্তাঘাট, অলিগলি, গাড়ি, নদী সব অবিকল এঁকেছেন ১৯ ফুটের বিরাট এক ক্যানভাসে।
২০১৪ সালের জুলাইয়ে উইল্টশায়ার সংক্ষিপ্ত এক হেলিকপ্টার ভ্রমণের পর সিঙ্গাপুর স্কাইলাইনের একটি (১X৪ মিটার) প্যানোরমিক স্কেচ সম্পন্ন করেন মাত্র পাঁচ দিন সময় নিয়ে। ২০১৫ সালে সিঙ্গাপুরের পঞ্চাশতম জন্মদিন উদযাপনের জন্য মূলত উইল্টশায়ার স্কেচটা করেছিলেন।
২০০১ সালে তিনি লন্ডনের ১২ টি ঐতিহাসিক ল্যান্ডমার্ক ও ২০০ টি সুপ্রাচীন ভবন পুরোপুরিভাবে বাস্তব মাপের অনুপাতে স্কেচ করেন মাত্র তিন ঘণ্টায়।
অসাধারণ ছবি আঁকার ক্ষমতা নিয়ে জন্মানো উইল্টশায়ারও অসুস্থতা নিয়ে জন্ম নেন। পাঁচ বছর বয়সে এসে আধো আধো কথা বললেও সাংকেতিক ভাষাতেই মানুষের সাথে যোগাযোগ করতেন তিনি। কথা বলতে পারতেন না বিধায় তাঁকে ভর্তি করানো হয় অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা করানোর একটি প্রতিষ্ঠানে। সেখানেই চিত্রাঙ্কনের উপর আগ্রহ তৈরি হয় তাঁর।
ছোটবেলা থেকেই চিত্রশিল্পী হিসেবে হাত পাকা ছিলো উইল্টশায়ারের। যেকোনো ধরনের ল্যান্ডস্কেপ একবার দেখলেই তা হুবহু কাগজে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন তিনি, যার জন্য উইল্টশায়ার মানব ক্যামেরা উপাধিও পেয়েছেন।